করোনা মানুষের রাজনৈতিক ধারণা পাল্টে দিতে পারে

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

সমাজ, সরকার ও রাজনীতির অনেক ক্ষত ও দুর্বল দিক প্রকাশ করে দিয়েছে অদৃশ্য শত্রু করোনাভাইরাস। এর কবলে পড়ে মানুষ জীবিকা ও চিকিৎসা নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। এ অসহায়ত্বই আগামী দিনে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের অনুঘটক হবে বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন করোনা পরিস্থিতির শিকার। তারা আর দুর্নীতি, প্রথাগত রাজনীতি ও অসৎ রাজনীতিকদের গ্রহণ করবে না।

এরই মধ্যে করোনাভাইরাস মানুষের স্বভাব-সংস্কৃতির অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। এই অতিমারি থমকে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি। এটি আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও বড় ধরনের বাঁকবদল হবে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। তবে তাঁদের আশঙ্কা, করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজনীতির শূন্য

মাঠে ক্ষমতাসীনেরা আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবে।

এ মুহূর্তে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও দলটির চিন্তাশীল মহলের দৃষ্টি অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির ওপর। কারণ তারা মনে করছে, সংক্রমণ পরিস্থিতি দেশে ও বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দাকে সামনে আরও কঠিন করে তুলবে। আর এর প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাশাপাশি ভূ-রাজনীতি বদলে দিতে পারে। এর সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগী বড় দেশগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর সমীকরণ আরও জটিল হবে আগামী দিনগুলোতে।

বিএনপির নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই দুর্যোগে মানুষের মনে মোটাদাগে দুটি বিষয় দাগ কেটেছে—একটি দেশের স্বাস্থ্য খাত ও চিকিৎসাব্যবস্থা, অন্যটি গরিব-দুস্থদের খাদ্যসহায়তা। দুটোতেই সরকারের বদনাম হয়েছে। বিশেষ করে এই সময়ে চিকিৎসাব্যবস্থা মানুষের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে দৌড়েও মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। অথচ এই সময়ের বাজেটেও ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য খাত সরকারের অগ্রাধিকার পায়নি, পেয়েছে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো কিছু মেগা প্রকল্প, যেগুলো তাদের জন্য ‘সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

করোনা পরিস্থিতির উল্লেখ করে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টাঙ্গাইলের মতো একটি পুরোনো জেলায় একটি পিসিআর ল্যাব নেই, একটা আইসোলেশন সেন্টার নেই। এই দুর্যোগে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে যে অব্যবস্থা, যে লুটপাটের কাহিনি—এসবের বিরুদ্ধেও একটা বড় আন্দোলন হতে পারত। কিন্তু সঠিক নেতৃত্বের অভাবে আমরা কিছুই করতে পারছি না।’

অন্যদিকে এই মহাদুর্যোগকালেও ব্যাপকভাবে সরকারি ত্রাণ চুরির অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারি দল সমর্থক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের ঘর বা মাটির গর্ত থেকে যেভাবে ত্রাণের চাল উদ্ধার করেছে, তা নতুন নজির সৃষ্টি করেছে। এই দুটি বিষয়ে সাধারণ মানুষের মুখে এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যে প্রতিক্রিয়া, তাতে স্পষ্ট যে সময়মতো এর রেশ বহুদূর যেতে পারে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর মূল্যায়ন হচ্ছে, সরকার ও সরকারি দলের দমননীতি, দুর্নীতি, বাজেট ঘাটতি ও অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং ভৌগোলিক রাজনীতিতে পরিবর্তনের কারণে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে।

বিএনপির নেতারা দেশের অর্থনীতিতে ঘোরতর অন্ধকার দেখছেন সামনে। করোনায় অর্থনেতিক সংকটে নিম্নবিত্তের অভাব আরও বাড়বে। করোনায় হযবরল অবস্থার মধ্যে বন্যা মানুষের হতাশা বাড়িয়েছে বলে মনে করেন নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাসুম চৌধুরী।

দলটির নেতারা বলেছেন, করোনার প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের সামর্থ্যমতো গরিব-অভাবীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু সরকারের একতরফা আচরণের কারণে এখন আর কেউ মাঠে নেই। প্রবাসী শ্রমিকেরা কাজ হারিয়ে দেশে ফিরছেন। আবার কর্মহীন হয়ে পড়া বা আয়–রোজগার না থাকায় মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরছেন। কিন্তু গ্রামে কাজ নেই। মানুষের শহর ছাড়ার এই একটি বিষয়ই দেশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বোঝার জন্য যথেষ্ট।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বর্তমান পরিস্থিতিকে কেবল সরকার নয়, গোটা জাতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুনরুদ্ধারে অনেক সময় লাগবে। সরকার যদি বাস্তবভিত্তিক নীতি নির্ধারণ না করে এবং তারা যদি কেবল দলীয় লোক, দলীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে থাকে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

এ পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বরের আগে করোনা নিয়ন্ত্রণে না এলে বা এর কার্যকরী প্রতিষেধক যদি বাজারে না আসে, তাহলে বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যাবে বলে মনে করছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। এই সময়ে কল-কারখানায় উৎপাদন সংকুচিত হয়ে লাখ লাখ মানুষের কর্মহীন হওয়ার পাশাপাশি তাঁদের কর্মস্পৃহাও নষ্ট হবে। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক ও সামাজিকভাবে এক বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

সাবেক স্পিকার ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকার মনে করেন, ‘এ রকম একটা অবস্থা থেকে উত্তরণে সমবেত চেষ্টা দরকার। কিন্তু সমবেত চেষ্টা করতে গেলে যে ধরনের নেতৃত্ব দরকার, তা আমাদের নেই। কাজেই এত তাড়াতাড়ি পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।’

অবশ্য করোনা পরিস্থিতিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সুযোগ হিসেবেও দেখছেন বিএনপির মাঠ নেতাদের অনেকে। তাঁদের ধারণা, অভাবে, কর্মহীনতায় ও আর্থিক বিশৃঙ্খলায় সরকার দুর্বল হতে পারে। এ অবস্থায় বিএনপিকে চলমান পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দলে শিক্ষিত ও সাহসী নেতৃত্ব সামনে এনে মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে।

দলের খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে মাঠে-ঘাটে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের প্রতিক্রিয়াগুলো যদি এক জায়গায় করি, তার সারবস্তু একটাই, তা হচ্ছে গতানুগতিক রাজনীতি বিদায় হয়ে যাবে। মানুষের চাওয়া মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা সম্পন্ন শিক্ষিত, মেধাবী ও সাহসী নতুন নেতৃত্ব। গত তিন মাসে করোনা এটিই জানান দিয়েছে।

অবশ্য এই সময়ে করোনার প্রভাব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথাগত চরিত্র পাল্টে দিচ্ছে। এখন আর রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে–বাইরের কোনো আলোচনাই একটেবিলে বসে হচ্ছে না। সবাই প্রযুক্তির মাধ্যমে জনসংযোগে মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন। বিএনপিও দলের নীতিনির্ধারণী বৈঠক, জরুরি সংবাদ সম্মেলনসহ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নেতাদের সঙ্গে দরকারি আলাপ-আলোচনা করছে অনলাইনে, বিভিন্ন অ্যাপসে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিষয়ভিত্তিক ১০টি আলোচনা সভাও হয়েছে অনলাইনে। এই করোনাতেই বাম দল ও নাগরিক ঐক্যের দুটি পৃথক সংলাপে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিয়েছেন বিএনপিসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।

সামনের দিনগুলোতে প্রযুক্তির প্রভাব ও ব্যবহার রাজনীতিতে আরও বাড়বে। মানুষ আর কখনো উন্মুক্ত জনসভায় অংশ নিতে উদ্ধুদ্ধ হবে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। কারণ, প্রথাগত জনসমাবেশের চেয়ে প্রযুক্তির সংযোগে বেশি মানুষের সাড়া মিলছে। সর্বশেষ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীর এক আলোচনায় ১০ লাখ ভিউয়ারের তথ্য পেয়েছে বিএনপির অনলাইন যোগাযোগ শাখা।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা জুম ব্যবহার করতে শিখে গেছি। অনেক নতুন অ্যাপস ব্যবহার করছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করলে এক-দুই লাখ লোক জমায়েত হয়। অ্যাপসে আমরা এর চেয়েও অনেক বেশি লোক পাচ্ছি।’ তিনি মনে করেন, দেশ এখন ক্রান্তিকালে আছে। করোনা-পরবর্তী মানুষের চিন্তা-ভাবনা, রাজনৈতিক ধারণাও পাল্টাবে। সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দেশ চালানোর যে দর্শন, সে প্রচলিত ধারণাও পাল্টাবে।

রাজনৈতিক মহল বলছে, বর্তমান এ পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের আরও বেপরোয়া ও কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার এরই অংশ।

নজরুল ইসলাম মনে করেন, এই করোনার সুবিধায় কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ভালো থাকে। তাদের বিরুদ্ধে গণ–আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ থাকছে না। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, পরিস্থিতির যে ইঙ্গিত, তাতে সরকার ব্যর্থ। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো যদি জোটবদ্ধ হয়ে একটা আস্থার জায়গা নিতে পারে, তাহলে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় রাজনীতির শূন্য মাঠ সরকারের জন্য কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়ে ভিন্নমতও আছে দলে। নেতাদের অনেকে মনে করেন, গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে লিখতে পারছে না, মানুষ মনের কথা বলতে পারছে না, এমন পরিস্থিতিতেও নানা মাধ্যমে, নানা উপায়ে সত্য প্রকাশ হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়ন মানুষের মনে ক্ষোভ আরও বাড়াচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরিবর্তন সব সময় রাজপথে হয় না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি-পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির সম্ভাবনা দেখছেন। তাঁরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়, নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং উদার গণতন্ত্র ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির চর্চা শুরু হয়। করোনার মহাদুর্যোগের পর এই অঞ্চলসহ দেশে দেশে কল্যাণ রাষ্ট্রের উত্থানের একটা সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

অবশ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মত একটু ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের লক্ষ্যে জনগণের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যে নাগরিক সমাজ; বিশেষ করে বিরোধী দলের যে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো থাকা প্রয়োজন, তা পুরোপুরিই ভেঙে দিয়েছে সরকার। ফলে এই সময়ে আমি দেশে কি বহির্বিশ্বে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আরও জেঁকে বসার আশঙ্কাই বেশি দেখছি।’

তবে দিলারা চৌধুরী এও বলেন, এ পরিস্থিতিতে ওই দেশগুলোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, যাদের ভেতরে ঐক্য আছে, দেশপ্রেম আছে এবং যে দেশের রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ এক হয়ে কাজ করবে, তারা ঘুরে দাঁড়াবে।