বন্যার কারণে গরুর পাইকারেরা আসছেন না

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তলিয়েছে গবাদিপশুর বিচরণক্ষেত্র ও কাঁচা ঘাসের জমি। তাই গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। পাইনপাড়া, জাজিরা, ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। তলিয়েছে গবাদিপশুর বিচরণক্ষেত্র ও কাঁচা ঘাসের জমি। তাই গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। পাইনপাড়া, জাজিরা, ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

বন্যায় শরীয়তপুরে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাড়ে তিন হাজারের বেশি খামারি। প্রায় ১৮ হাজার গরু-ছাগল পানিবন্দী অবস্থায় আছে। তলিয়ে গেছে এলাকার গোচারণভূমি। দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের তীব্র সংকট।

দুই সপ্তাহ আগে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শরীয়তপুরের লোকালয় প্লাবিত হতে শুরু করে।
গতকাল শুক্রবার রাতে পদ্মা নদীর পানি নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আজ শনিবার সকালে ভাটার সময় তা কমে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
এরই মধ্যে জেলার সদর, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও জাজিরা উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের সাড়ে ৩০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ৩ হাজার ৬০০ খামারি এখন পড়েছেন বিপাকে। ঘরবাড়ির পাশাপাশি গোচারণভূমি ও ঘাস উৎপাদনের জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে নিজেদের থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি গবাদিপশু নিয়েও চিন্তা করতে হচ্ছে।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাচিকাটা ইউনিয়নটির চারদিক দিয়ে পদ্মা নদী। পুরো ইউনিয়নটিই এখন বন্যাকবলিত হয়ে পানির নিচে। কাচিকাটার শিবসেন এলাকার বাসিন্দা দিদারুল মিয়া বলেন, ‘আমাদের এ এলাকায় পদ্মা নদীর চর হওয়ায় অনেক খামারি স্বাচ্ছন্দ্যে গরু-ছাগল লালন-পালন করতে পারেন। এখানকার গবাদিপশু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুরের পাইকারেরা কিনে নিতেন। বন্যার কারণে কোনো পাইকার আসছেন না। আমরাও বিক্রি করতে পারছি না। বন্যার পানিতে গ্রাম ভাসছে, আমাদের জীবন-জীবিকা সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গরু-ছাগল আমাদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও তাদের পরম যত্নে আগলে রাখছি। এখন একসঙ্গেই উঁচু স্থানে থাকছি।’

কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য ছাগল প্রস্তুত করেছিলেন জাজিরার আহম্মদ মাঝিকান্দি গ্রামের ইয়াসিন মাঝি। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় কলার ভেলায় করে দূর থেকে ছাগলের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য ছাগল প্রস্তুত করেছিলেন জাজিরার আহম্মদ মাঝিকান্দি গ্রামের ইয়াসিন মাঝি। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে যাওয়ায় কলার ভেলায় করে দূর থেকে ছাগলের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

জাজিরার পাইনপাড়া গ্রামের খামারি আবদুর রশিদ মোল্যা। খামারের আয় দিয়েই সংসার চলে। কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য তিনি আটটি গরু প্রস্তুত করেছেন। কিন্তু বন্যায় গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। এখন না পারছেন গরু বিক্রি করতে, না পারছেন প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ দিতে।
আবদুর রশিদ মোল্যা বলেন, ‘একটি গরুও কোরবানির হাটে নিতে পারছি না। বন্যায় চারদিক তলিয়ে যাওয়ায় কোনো ক্রেতাও পাওয়া যাচ্ছে না। করোনার কারণে রোজার ঈদে গরু বিক্রি করতে পারিনি। আশা ছিল কোরবানিতে বিক্রি করার। কিন্তু কোনো লক্ষণ দেখছি না। গরু বিক্রি করতে না পারলে পথে বসে যেতে হবে। কারণ, কোরবানির পর আর ভালো বাজার পাওয়া যাবে না।’
নড়িয়ার রাজনগর মালতকান্দির গবাদিপশুর খামারি মোকলেছ সরদার বলেন, ‘বন্যার পানিতে সারা গ্রাম তলিয়ে গেছে। বসতবাড়ির উঠানে উঁচু করে গবাদিপশু রাখতে হয়েছে। পাঁচটি গরু কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। মনে হচ্ছে বিক্রি করতে পারব না। এমন পরিস্থিতিতে আমার অনেক টাকা লোকসান হবে।’
এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে খামার করেছিলেন জাজিরার বিলাসপুর এলাকার সজল ব্যাপারী। খামারে রয়েছে পাঁচটি ছাগল ও তিনটি গরু। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে খামারটি করেছিলাম। বিক্রি করতে না পেরে দুশ্চিন্তায় আছি কীভাবে ঋণের টাকা পরিশোধ করব।’

ঘরের ভেতর পানি। তাই নিজেদের থাকার চৌকিতে গবাদিপশু রেখেছেন দেলোয়ার হোসেন। মাঝিকান্দি গ্রাম, জাজিরা, শরীয়তপুর। ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো
ঘরের ভেতর পানি। তাই নিজেদের থাকার চৌকিতে গবাদিপশু রেখেছেন দেলোয়ার হোসেন। মাঝিকান্দি গ্রাম, জাজিরা, শরীয়তপুর। ২৫ জুলাই। ছবি: প্রথম আলো

জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্র অনুযায়ী জেলায় আট হাজার খামারি গবাদিপশু লালন-পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বন্যাকবলিত চার উপজেলায় খামারির সংখ্যা ছয় হাজারের মতো। তাঁদের মধ্যে ৩ হাজার ৬০০ খামারি বন্যার পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে ১০ হাজার একর গোচারণভূমি ও কাঁচা ঘাসের জমি।
জানতে চাইলে শরীয়তপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুবোধ কুমার দাস বলেন, এ বছর কোরবানির হাটে বিক্রি করার জন্য খামারিরা ৩৫ হাজার গরু-ছাগল প্রস্তুত করেছেন। গবাদিপশু বিক্রির ছয়টি স্থায়ী হাট রয়েছে জেলায়। এ ছাড়া কোরবানি উপলক্ষে ৩২টি অস্থায়ী হাট বসে। কিন্তু বন্যার কারণে একটি অস্থায়ী হাটও এখনো চালু হয়নি। তাই খামারিদের গরু-ছাগল অবিক্রীত থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বন্যার কারণে গবাদিপশু খাতে ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।