লবণের জন্য সাঁতরে যাচ্ছিলেন বোনের বাড়ি

যমুনার জলে ভাসছে হাটবাড়ি চর। ছবি: সোয়েল রানা
যমুনার জলে ভাসছে হাটবাড়ি চর। ছবি: সোয়েল রানা

একটি বসতবাড়ি থেকে সাঁতরে আরেকটি বসতবাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন মমতা বেগম (৪০)। সামনে ডিঙি পেয়ে কোনোরকমে সাঁতরে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘এক মাস ধরে যমুনার জলত ঘর-সংসারডা ভাসিচ্চে। সোয়ামি ইউনুস আলী দিনমজুর। হাতত কাম নাই। উপার্জন নাই। ঘরত কেজি চারেক চাল আচে। তরিতরকারি, ডাল, তেল-নুন, মরিচ কিচ্চু নাই। দুদিন থ্যাকে চুলা জ্বলেনি, প্যাটত ভাতও জোটেনি। দুপুরত খিচুরি রান্ধমো, নুন-পত্তা নাই। অ্যাকনা নুন–পত্তা লিবার বোনের বাড়িত যাচ্চি। লৌকা নাই, তাই সাতরাচ্চি।’

এই দৃশ্য যমুনা নদীর মাঝখানে হাটবাড়ি চরের। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কালীতলা খেয়াঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো গেল দুর্গম এই চরে।
বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে যমুনা নদীর এই দুর্গম চরে প্রায় সাড়ে চার হাজার দরিদ্র মানুষের বাস। চরের মানুষের জীবিকা চলে যমুনায় মাছ ধরে। অনেকেই দিনমজুর, প্রান্তিক কৃষক। প্রায় এক মাস ধরে উত্তাল যমুনার জলে ভাসছে এই চরের লোকালয়। অলিতে–গলিতে প্রবল স্রোত। চলছে ডিঙি। কোনো কোনো বসতবাড়ির উঠানে-বারান্দায় বুকসমান পানি। কোনো কোনো বসতঘরেও বুকসমান পানি।
এর মধ্যে পূর্ব হাটবাড়ি চরে বসবাস ছিল প্রায় ৩০০ পরিবারের। এক মাস ধরে জলবন্দীর দুর্ভোগের সঙ্গে শুরু হয় নদীভাঙন। ভরা বর্ষায় বসতবাড়ি হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো কেউ দক্ষিণ হাটবাড়ি চরে, কেউ পার্শ্ববর্তী ইসলাম উপজেলার চরে, কেউ সাঘাটার পাতিলবাড়ি চরে আবার কেউ সোনাতলা উপজেলার তেকানিচুকাইনগর গুচ্ছগ্রামে এবং সুজনের পাড়া চরে আশ্রয় নিয়েছে।
প্রায় ১০০ পরিবার দক্ষিণ হাটবাড়ি চরে আশ্রয় নিলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি। এখানে এসেও প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঘরের ভেতর বুকসমান পানিতে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষেরা।
পূর্ব হাটবাড়ি চরে আশ্রয় নেওয়া বৃদ্ধ মফিজ উদিন (৭৫) এবং শহরভানু (৬০) বুকসমান পানিতে তলিয়ে যাওয়া একটি বসতঘরের আঙিনায় নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। মফিজ বলেন, ‘দেড় মাস ধরে বানত ভাসিচ্চি। বুড়া মানুষ কাম করবার পারি না।’

নৌকায় করে ত্রাণের আশায় এদিক–ওদিক ছুটছে বানভাসী মানুষেরা। ছবি: সোয়েল রানা
নৌকায় করে ত্রাণের আশায় এদিক–ওদিক ছুটছে বানভাসী মানুষেরা। ছবি: সোয়েল রানা

পানিতে থইথই করছে বাড়ির উঠান, বারান্দা। বাড়ির উঠানে একটি ডিড়ি ভাসছে। নৌকায় ৭-৮ কেজি ভেজা চাল শুকাচ্ছেন দিনমজুর মঈনুদ্দিনের স্ত্রী আজিরন বেগম (৪৫)। বলেন, ‘এক মাস ধরে বানত ভাসিচ্চি। সংসারত চারডা ছল। ইলিপের ১০ কেজি চাল পাচনো, বানের পানিত সেকনা ভিজে জবজব। সেই চাল শুকাচ্চি, ঘরত নুন-তেল কিচ্চুই নাই।’
দিনমজুর মনোহারের স্ত্রী ঝরনা বেগম (৩৫) বলেন, ‘বসতঘর যমুনা ঢলে ভাসে গেচে। ঘরত চাল নাই। বিয়ানবলা অ্যাকনা পত্তা দিয়ে পন্তা খাচি। ছলগুলার প্যাটত কিচ্চু পড়েনি।’ আফরোজা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘ছয় মাস যমুনার জলত, আর ছয় মাস ডাঙ্গাত হামাকেরে সংসার। দেড় মাস থ্যাকে বানত ভাসিচ্চি। চরের সব পানির কল বানত ডুবে গেচে। লদির পানি খাচ্চি।’
আয়েন উদ্দিনের স্ত্রী জয়ফুল বেগম সাঁতরে এক কলসি পানি নিয়ে বসতঘরে আসছিলেন। বলেন, ‘সব টিউবওয়েল ঢলের পানিত তলিয়ে গেচে। অ্যাকনা টিউবওয়েল আধাআধি জেরে আচে, সেটি থাকি সগলি কলসিত পানি লিয়ে আসিচ্চে। হামিও সাঁতরিয়ে যায়্যা পানি লিয়ে আসিচ্চি।’
হাটবাড়ি চরের অসহায় বিধবা জহরু বেওয়া বলেন, ‘দশডা দিন থ্যাইকা জামাইয়ের বাড়িত আচি। ঘরত এক মুঠ চাল নাইক্যা। তোন ইলিপ পাই নাইক্যা।’
সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা সালমা বেগম বলেন, ‘বানের ঢলত ভয় লাগে। লৌকাত নির্ঘুম রাত কাটাচ্চি। ভাত আন্দাবাড়ি করা যাচ্চে না। খাওয়ার পানির অভাব। পায়খানা-প্রস্রাব করা যাচ্ছে না।’

ঘরে থাকা চাল ভিজে যাওয়ায় শুকিয়ে নিচ্ছেন আজিরন বেগম। ছবি: সোয়েল রানা
ঘরে থাকা চাল ভিজে যাওয়ায় শুকিয়ে নিচ্ছেন আজিরন বেগম। ছবি: সোয়েল রানা

সারিয়াকান্দি চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই ইউনিয়নের ১৩টি চরের প্রায় ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী। কয়েক হাজার মানুষ অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। দুর্গতদের মধ্যে পরিবারপ্রতি ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো.রাসেল মিয়া বলেন, এই উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিক। দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।