ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে সংক্রমণ কম

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে করোনা সংক্রমণ কম দেখা যাচ্ছে। কিছু এলাকায় প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো সংক্রমণই দেখা যায়নি। যেখানে সংক্রমণ দেখা গেছে, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যাও খুব কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো জনগোষ্ঠী কীভাবে নিজেদের রক্ষা করল, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি, এমন ১২টি উপজেলায় করোনা সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। তাতে দেখা গেছে, ছয় জেলার ছয়টি উপজেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। উপজেলাগুলো হচ্ছে পাঁচবিবি (জয়পুরহাট জেলা), নালিতাবাড়ী (শেরপুর), মধুপুর (টাঙ্গাইল), ভালুকা (ময়মনসিংহ), কলমাকান্দা (নেত্রকোনা) ও গোদাগাড়ী (রাজশাহী)।

বাকি চার জেলার ছয়টি উপজেলায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে আক্রান্তের হার মূলধারার জনগোষ্ঠী কিংবা বাঙালিদের তুলনায় অনেক কম। এসব উপজেলা হচ্ছে কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার জেলা), বান্দরবান সদর (বান্দরবান), রাঙামাটি সদর (রাঙামাটি), কাপ্তাই (রাঙামাটি) এবং খাগড়াছড়ি সদর (খাগড়াছড়ি)।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো হয়তো নিজেদের মতো করে একটা নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পেরেছে। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ, ব্রাজিলের আমাজন এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে একসময় সংক্রমণ কম থাকলেও এখন তা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।’

সরকারি হিসাবে দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা আছে ৫০টি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ। এরা সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রাম, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে এদের বসতি বেশি।

তিন দশকের বেশি এসব জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ গাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এদের আচার–আচরণ, অভ্যাস মূলধারার জনগোষ্ঠীর চেয়ে আলাদা। এরা ঘরমুখী, নিরিবিলি থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাজারঘাটে কম আসে। এসব কারণেই হয়তো এদের মধ্যে সংক্রমণ কম দেখা গেছে।

কেউ আক্রান্ত হননি

উত্তরের জেলা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় মুন্ডারা বাস করে। মুন্ডাদের ছোট একটি সংগঠনের নাম পামডো। এর নির্বাহী প্রধান হৈমন্তী সরকার বলেন, মুন্ডারা ‘বাইরের লোকজনের’ সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করে না বলে তাদের মধ্যে সংক্রমণ দেখা দেয়নি।

সরকারি কর্মকর্তাদের হিসাবে পাঁচবিবি উপজেলার জনসংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার ৭৯৭ জন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ১১ শতাংশ। উপজেলায় এ পর্যন্ত ১০৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর কেউ নেই।

দেশের যেসব জায়গায় করোনা সংক্রমণ বেশি হয়েছে, গাজীপুর তার অন্যতম। গাজীপুরের কয়েক কিলোমিটার উত্তরে ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলা। এই উপজেলায় এখন পর্যন্ত ২৭৫ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখানে ১৩ হাজারের বেশি কোচ ও মান্দি বাস করলেও তাঁরা কেউ আক্রান্ত হননি বলে উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে।

আক্রান্ত, তবে কম

‘বাইরের কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না, ভেতরের কেউ বাইরে যেতে পারবে না—লকডাউনের এ নীতি আমরা শুরু থেকে কঠোরভাবে অনুসরণ করেছি। সম্ভবত সেই কারণে কোনো খাসিপুঞ্জির একজনও করোনায় আক্রান্ত হননি।’ এ কথাগুলো ডাবলছড়া ও মাগুরছড়া পুঞ্জিপ্রধান পিডিশনপ্রধান সুচিয়াংয়ের।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার খাসি বসবাস করে। সাধারণত উঁচু টিলার ওপর তাঁদের গ্রামগুলোকে পুঞ্জি বলা হয়। পান চাষ তাঁদের অন্যতম প্রধান জীবিকা।

পিডিশনপ্রধান সুচিয়াং প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনের ঘোষণা আসার পরপরই সব পুঞ্জির প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পান ব্যবসায়ীদের ভেতরে ঢোকা বন্ধ করা হয়। পানপুঞ্জির বাইরে নিয়ে বিক্রি করা হয়। ঢাকা বা অন্য বড় শহর থেকে শিক্ষার্থী বা অন্য যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের ১৪, ২১ ও ২৮ দিন গ্রামের বাইরে ঘর তৈরি করে রাখা হয়েছিল।

এ দুই উপজেলায় মণিপুরিদের বসবাস আছে। তা ছাড়া এখানকার চা–বাগানগুলোতে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কমলগঞ্জ উপজেলায় এ পর্যন্ত ৮৯ জন শনাক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মণিপুরি ৪ জন ও চা–শ্রমিক ৩ জন। এ ছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে ২ জন চা–শ্রমিক মারা গেছেন।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর একটি বড় অংশ বাস করে তিন পার্বত্য জেলায়—বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, বম, তঞ্চঙ্গ্যাসহ ১০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এ জেলাগুলোতে বসবাস করে। তিনটি জেলার সদর উপজেলাগুলোতে অর্থাৎ জেলা শহরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও বাঙালি জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় সমান। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে। বান্দরবান সদরে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩৮ জন। তাদের মধ্যে ২৪০ জন বাঙালি ও ৯৮ জন পাহাড়ি।

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের করোনাবিষয়ক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা চিকিৎসক তাওহিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাদ্যাভ্যাস ও কঠিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার কারণে হয়তো ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। এ ছাড়া তারা এমন সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত, যেখানে স্বাভাবিকভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি মেনে চলা হয়। এগুলোই সংক্রমণ কম হওয়ার সম্ভাব্য কারণ।’

রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সদরে আক্রান্ত হয়েছেন যথাক্রমে ৩৪০ জন ও ১৯০ জন। সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় জানিয়েছে, এঁদের ৩০ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাঙামাটিতে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের গবেষণা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের নানা ধরন দেখা যাচ্ছে। এ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলো কী উদ্যোগ নিয়েছে, দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তা জানা দরকার।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জয়পুরহাট, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি)