বৃষ্টিদিনের এলোমেলো ভাবনা

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আষাঢ় চলে গেল, এখন শ্রাবণ মেঘের দিন। বর্ষা এলেই এখনো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য মন আকুল করে। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি। মনে গুনগুনিয়ে উঠছে দেশাত্মবোধক গানের প্রিয় একটা লাইন ‘এখানে বৃষ্টি ঝরে রিমঝিম শ্রাবণের সেতারে।’

করোনাকালের ঘরবন্দী জীবনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কত এলোমেলো স্মৃতি মনে ভাসছে।

একবার মেয়ের স্কুল ছুটির পর ঝুমবৃষ্টি শুরু হলো। সবাই বৃষ্টি থামার জন্য বা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ মাথায় চাপল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় যাই। মেয়েকে বলতেই রাজি। কিন্তু বাদ সাধল মেয়ের স্কুলব্যাগ। অগত্যা ছাতা মাথায় দিয়ে মেয়ের হাত ধরে রাস্তায় নামলাম। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে’ গাইতে গাইতে মা-মেয়ে এগোচ্ছি। একটা প্রাণী এমনকি একটা রিকশাও রাস্তায় নেই। চারদিকে শুধুই বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। বৃষ্টির শব্দে আমাদের গান শুধু আমরাই শুনছিলাম। আশপাশের দোকানের লোকজন নিশ্চয়ই আমাদের খুব বোকা ভেবেছিল। কিন্তু শুধু আমরাই জানি সেদিন কতখানি উপভোগ করেছিলাম।

বৃষ্টির দিনগুলো এখন আর মুখর হয়ে ওঠে না। মনে হয় আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন কান্না হয়ে ঝরছে। চারদিকে এত মৃত্যু, এত কান্না। মনটা বিষাদে ভরে ওঠে।

বাসার সামনের রাস্তাটার দিকে চোখ পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। শুধুই কয়েকজন পথচারীর চলাচল। খুব প্রয়োজনের তাগিদেই হয়তো বের হয়েছে। অথচ লকডাউনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে সারা দিন শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখরিত থাকতো।

সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় খুব কাছাকাছি চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভিকারুননিসা নূন স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, মগবাজার গার্লস স্কুল, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি। সারা দিন রাস্তায় শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। দুপুর ১২টায় ভিকারুননিসা স্কুলের মর্নিং শিফট শেষ, ডে শিফট শুরু। রাস্তার দুপাশে ইউনিফর্ম পরা মেয়েদের একটা স্রোত স্কুলের দিকে যাচ্ছে। আরেকটা স্রোত স্কুল থেকে ফিরছে। রাস্তায় প্রাইভেট কার আর রিকশার তো অভাব নেই। মাঝেমধ্যে এমন জ‍্যাম হতো যে হাঁটার পথ থাকত না, খুব বিরক্ত হতাম। এখন সেই দিনগুলো ফিরে পাওয়ার জন্যই হাহাকার।

‘মামা, ১০ টাকার ঝালমুড়ি; মামা, ১০ টাকার ফুচকা বা চটপটি’—এসব কথা শুধুই কানে বাজে। আচ্ছা, সব স্কুলের সামনে এই যে এত ঝালমুড়ি, ফুচকা, ভেলপুরির পসরা সাজিয়ে যাঁরা দাঁড়িয়ে থাকতেন; স্কুল ছুটির পর তো তাঁদের হাত এতটুকু অবসর পেত না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময় তাঁরা এখন কোথায়? তাঁদের জীবিকার কি কোনো ব্যবস্থা হলো? এক যুগ ধরে যে ঝালমুড়ি বিক্রেতাকে স্কুলের সামনে দেখে এসেছি, তিনি কি গ্রামে ফিরে গেছেন? ফুচকা বিক্রেতা যে ছেলেটাকে কয়েক দিন না দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত দিন কোথায় ছিলে? আনন্দে ঝলমল করে বলেছিল, আন্টি, ঢাকায় বাসা ভাড়া করে বাবা-মাকে নিয়ে এসেছি। লাজুক মুখে একটা মেয়ের ছবি দেখাল। কদিন পরেই এ মেয়েটার সঙ্গে তার বিয়ে। খুব জানতে ইচ্ছা করে ছেলেটির কথা। তারা কি ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে? তাদের সবার জন্য মনটা হু হু করে কাঁদে।

জীবিকার তাগিদে যাঁরা একদিন ঢাকায় এসেছিলেন; কাজ না থাকায় তাঁরা আবার ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। টিভি নিউজে দেখলাম, পরিবারের সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, এমন একটি মেয়ে বলছে, তার এত দিনের স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটার কষ্টের ঢেউ যেন আমার বুকে এসে আছড়ে পড়ল। সে কি আবার তার বন্ধুদের ফিরে পাবে?

দেশের কত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, মাত্র কটা দিন পরেই যাদের বোর্ড পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। ১২ বছরের সাধনার পর সবার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যাওয়ার। হয়তো কারও স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা শিক্ষক বা অন্য কোনো পেশা।

এই যে এত স্বপ্নভঙ্গ, এত অনিশ্চয়তা, তারপরও জীবন থেমে নেই, থেমে থাকে না। আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে। নিশ্চয়ই একদিন কার্যকরী ভ‍্যাকসিন আবিষ্কার হবে। পরম করুণাময় নিশ্চয়ই আবার সব স্বাভাবিক করবেন।

‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে
শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে
মঙ্গলও বারতা।’