আর পারছে না বন্যা দুর্গত মানুষ

ত্রাণের নৌকা দেখে ছুটে আসছেন এক বন্যার্ত নারী। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খাসের চরে। ছবি: প্রথম আলো
ত্রাণের নৌকা দেখে ছুটে আসছেন এক বন্যার্ত নারী। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার খাসের চরে। ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলার ও দুধকুমার নদ–নদীর পানি সামান্য কমলেও এখনো বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

এ অবস্থায় জেলার প্রায় সাড়ে চার শ চরাঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক বন্যাদুর্গত মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে গবাদিপশু নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে আছে। দীর্ঘ সময় পানিবন্দী থাকা দুর্গম চরাঞ্চলের পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে গৃহপালিত পশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এতে করে উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়ছে বন্যাদুর্গত মানুষের ভিড়।

ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার চিলমারী উপজেলায় নযারহাট ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ খাউরিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভাঙন শুরু হয়েছে। স্থানীয় লোকজন গাছের ডাল ও বাঁশ নিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছেন। ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে কলেজের নতুন ভবন, বাজার আশ্রয়কেন্দ্র ও প্রাথমিক বিদ্যালয়।

স্থানীয় বাসিন্দা সাজেদুল ইসলাম ও রাশেদুল ইসলাম জানান, ব্রহ্মপুত্র নদ ছিল আধা কিলোমিটার দূরে। ভাঙতে ভাঙতে শুক্রবার স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসে লেগেছে। পেছনে ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো এলাকা নদের পেটে যাবে।

বন্যায় উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালের চর, গুজিমারি, বালাডোবার চর ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চর, চর যাত্রাপুরসহ কয়েকটি চর ঘুরে জানা যায়, দীর্ঘ এক মাস নৌকায় ও ঘরের মাচানে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু পানি নামার কোনো লক্ষণ নেই। পানির ওপর খাওয়া, ঘুম, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের কষ্ট করে এক মাস পার করেছে। এভাবে থাকায় তাদের সমস্যা আরও বেড়েছে। তাই বাধ্য হয়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছে লোকজন। এতে করে উঁচু বাঁধ, পাকা সড়ক ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বাড়ছে বন্যাদুর্গতদের সংখ্যা।

জেলার বন্যাকবলিত দুর্গম এলাকার চর ও দ্বীপ চরগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ চরের বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। পরিবার–পরিজন ও গবাদিপশু উঁচু স্থানে রেখে এসে দু–তিনজন করে বন্যার্ত মানুষ নৌকায় করে পানিতে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও যে চরগুলোতে দুর্গত মানুষেরা নৌকায় ও ঘরের ভেতর কষ্ট করে বসবাস করে আসছিল, সেখানকার বেশির ভাগ ঘরবাড়ি এখন ফাঁকা পড়ে আছে।

ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর যাত্রাপুরের ইয়াছিন আলী বলেন, তাঁরা কষ্ট করে ১০টি পরিবার পানির মধ্যে কষ্ট করে বসবাস করছিলেন। কিন্তু এক মাস পরও পানি নামছে না। পানিতে ছোট ছোট বাচ্চা, গরু-ছাগল নিয়ে আর কত দিন থাকা যায়। তাই পার্শ্ববর্তী উঁচু সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা পালা করে নৌকায় বসে থেকে দিন-রাত ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছেন।

বন্যার্ত মানুষজনের এখন একটাই অভিযোগ, তারা খেয়ে না-খেয়ে দীর্ঘদিন পানির মধ্যে আছেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের কোনো খোঁজও নেননি।

এ বিষয়ে সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী সরকার ও বেগমগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের তুলনায় ত্রাণের যে চাল বরাদ্দ পেয়েছেন, তা দিয়ে অর্ধেক পরিবারকেও দেওয়া সম্ভব হয়নি।

জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম বলেন, জেলার ৯ উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য এ পর্যন্ত ১৯০ মেট্রিক টন চাল, ৯ লাখ নগদ টাকা, শিশুখাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা, গো-খাদ্যের জন্য ৪ লাখ টাকা ও ৮ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তাঁদের কাছে আরও ত্রাণের চাল ও টাকা মজুত আছে। প্রয়োজনে সেগুলোও বিতরণ করা হবে।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার এবং ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নয়ারহাটে এর আগে সাড়ে চার শ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ভাঙনের কথা জেনেছেন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।