৯০ লাখ মানুষ জানেই না, তারা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত

দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ৯০ লাখ মানুষই জানে না, তারা আক্রান্ত। হেপাটাইটিস নির্মূলে এই অজানা রোগীদের শনাক্ত করা জরুরি। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হেপাটাইটিস নির্মূল করতেই হবে। তাই দেশে বিনা মূল্যে হেপাটাইটিস শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালু করা প্রয়োজন। সরকার ও জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে দ্রুত হেপাটাইটিস প্রতিরোধ কৌশলপত্র প্রণয়ন করা জরুরি।

গতকাল সোমবার ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আসুন খুঁজি লক্ষ অজানা রোগী’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো ও হেপাটোলজি সোসাইট, ঢাকা বাংলাদেশ।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি মবিন খান। তিনি বলেন, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের ৯ জনই জানে না, তারা হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্ত। হেপাটাইটিস নির্মূলে এই রোগীদের শনাক্ত করা জরুরি। দেশে বিশেষজ্ঞ লিভার চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে সরকারি, বেসরকারি অংশীজনদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

হেপাটাইটিস ভাইরাসের ইতিহাস ও রোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমানে হেপাটাইটিস এ, বি, সি ও ডি রয়েছে। আরও হেপাটাইটিস ভাইরাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। লিভার সেলে হেপাটাইটিস–বি ভাইরাসের উপস্থিতি ছাড়া হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাস জন্মাতে পারে না। তবে হেপাটাইটিস-ডি ভাইরাসের সাহায্যে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

হেপাটোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক শাহিনুল আলম বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি লিভার রোগীর জন্য মাত্র ১০০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। গর্ভকালে, অস্ত্রোপচার, ডায়ালাইসিস ও রক্ত বা রক্তজাত দ্রব্য গ্রহণের আগে হেপাটাইটিস পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জন্মের পরপরই শিশুকে হেপাটাইটিস ‘বি’-এর টিকাদান নিশ্চিত করা জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) মোজাহেরুল হক বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস নির্মূল করতে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এটি নির্মূল সম্ভব না। এটি নির্মূলে সরকার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কৌশল ঠিক করতে হবে। হেপাটাইটিসের টিকা আরও সহজলভ্য করতে হবে। 

আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ পরিচালক তাহমীদ আহমেদ বলেন, দেশে ২০০৪ সাল থেকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) মাধ্যমে হেপাটাইটিসি-বির টিকা দেওয়া হচ্ছে। এই টিকা যারা পায়নি, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৬-১৭ বছরের বেশি তারা ঝুঁকিতে রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ৫টির সঙ্গে হেপাটাইটিস নির্মূলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। 

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সূচনা বক্তব্যে বৈঠকের শুরু হয়। বৈঠকে হেপাটোলজি সোসাইটির বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক মো. গোলাম আযম বলেন, দেশে হেপাটাইটিস বা লিভারের প্রদাহ মূলত ভাইরাস দিয়ে হয়। মদ্যপানজনিত, মাদকের কারণেও হেপাটাইটিস হতে পারে।

তাহমিদ আহমেদ ও মোজাহেরুল হক
তাহমিদ আহমেদ ও মোজাহেরুল হক

৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে গর্ভবতী মা থেকে নবজাতকে হেপাটাইটিস ভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে বলে জানান ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও বারডেম হাসপাতালের গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান ফেরদৌসী বেগম।

লিভার বিশেষজ্ঞ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অ্যাকিউট ও ক্রনিক হেপাটাইটিস, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী হেপাটাইটিস-বি। ২০০৭ সালে দেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যে হেপাটাইটিস-বির প্রার্দুভাব ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এখন সেটি কমে অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। 

বিএসএমএমইউর হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীর পরিণতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে রোগীর বয়সের ওপর। ছোটদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগ সেরে যায়। হেপাটাইটিস-সি আক্রান্তদের ৮৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি লিভারের প্রদাহে ভোগেন।

লিভার ব্যাধির কনসালট্যান্ট মোতাহার হোসেন বলেন, হেপাটাইটিস বি ও সির বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা শুরু ও শেষ হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের কাছে। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া এটি
নির্মূল সম্ভব না।

হেপাটাইটিস-বি পজিটিভ ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ রোগীরই চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না বলে জানান হেপাটোলজি সোসাইটির সহসভাপতি অধ্যাপক মো. আবু সাঈদ। 

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) তানভীর আহমাদ বলেন, হেপাটাইটিসের অজানা রোগীদের খুঁজে বের করা না গেলে তাঁদের মাধ্যমে প্রতিবছর কয়েক লাখ লোক নতুন আক্রান্ত হবে। যাঁদের লিভারের সমস্যা রয়েছে তাঁরা কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হলে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। 

হেপাটাইটিস নির্মূলে হেলথ কমিউনিকেশন বা স্বাস্থ্য যোগাযোগ বিষয়ে জোর দিতে হবে বলে মনে করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। 

কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক এস কে এম নাজমুল হাসান বলেন, হেপাটাইটিস রোগ শনাক্তের পরীক্ষা বিনা মূল্যে করতে হবে। তৃণমূল ও প্রত্যন্ত এলাকায় এই পরীক্ষার সুবিধা পৌঁছাতে হবে। 

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।