সেই দিনের স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে ১২ শিক্ষার্থীকে

বাসে চাপা দেওয়া সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে আহত ১২ শিক্ষার্থীকে। দুই বছর আগে এই দিনে রাজধানীর কুর্মিটোলা উড়ালসড়কের ঢালে যাত্রীবাহী তিনটি বাসের রেষারেষিতে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম ও আবদুল করিমের প্রাণ কেড়ে নেয়। ওই ঘটনায় একই প্রতিষ্ঠানের ১২ শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।

সেই ভয়াবহ ঘটনায় কারও হাত, কারও পা ভেঙে গেছে। কারও মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে, আবার কারও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে গেছে। সবাইকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছিল। কয়েকজন শিক্ষার্থী এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি, শরীরে ক্ষত রয়ে গেছে। সরকার সে সময় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার টাকা করে দিয়েছিল। এই শিক্ষার্থীরা এখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন।

ওই সময় হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গিয়েছেন সে সময়ের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি আহত শিক্ষার্থীদের চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আহত শিক্ষার্থীরা প্রথম আলোকে বলেন, ২৯ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ছুটি শেষে ১৪ থেকে ১৫ জন ছাত্রছাত্রী হোটেল র‌্যাডিসনের উল্টো দিকে কুর্মিটোলা উড়ালসড়কের ঢালে ফুটপাতে গাছের নিচে দাঁড়ান। তাঁরা সবাই যাঁর যাঁর বাসার ফেরার জন্য বাসে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় জাবালের নূর পরিবহনের দুটি বাসের রেষারেষির মধ্যে একটি বাস বাস সড়কের বাঁ পাশ ঘেঁষে দ্রুতগতিতে ছুটে এসে উড়ালসড়কের রেলিং ঘেঁষে গাছটিকে ধাক্কা দিয়ে শিক্ষার্থীর ওপর তুলে দেয়।

সেই ঘটনায় রমিজউদ্দিনের কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা বিশ্বাস মাথা ও কানে আঘাত পেয়েছিলেন। গত বছরে ওই কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তিনি এখন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলেজে মার্কেটিংয়ে (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন।

প্রিয়াংকা বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেই ভয়ংকর স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। কলেজ ছুটির পর আমরা জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসে উঠতে যাই। মুহূর্তের মধ্যে জাবালে নূর পরিবহনের আরেকটি বাস দানবের মতো ছুটে এসে আমাদের ওপর তুলে দেয়। এরপর আর কিছু মনে নেই। কয়েক দিন পরে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পাই। তখন স্বজনেরা বলেছেন আমাকে বাস চাপা দিয়েছিল। বন্ধুদের কাছে শুনেছি বাসের নিচে আটকা পড়েছিলাম। ওরাই সেখান থেকে টেনে বের করেছিল।’

প্রিয়াংকা বলেন, সিএমএইচের আইসিইউতে সাত দিন থাকার পর তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। মাথায় অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। তবে এখনো প্রতিদিন মাথা ও কানে ব্যথা হয়। সে জন্য পড়াশোনা করতেও কষ্ট হয়। প্রিয়াংকা বলেন, চিকিৎসক দেখিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। মাথাব্যথার কারণে গত বছরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি তিনি। তিনি বলেন, এখনো গাড়িতে উঠলে আঁতকে ওঠেন তিনি।

আরেক শিক্ষার্থী সজীব শেখের বাঁ হাত ভেঙে যায়। ওই হাতের ভাঙা স্থানে জোড়া লাগাতে ইস্পাতের পাত বসাতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল।

সজীব শেখ জানান, চিকিৎসকেরা বলেছিলেন দুই বছর পর ইস্পাতের পাত সরিয়ে ফেলতে হবে। এখন সময় হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছি না। তিনি বলেন, গত বছরে রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেছেন। এখন তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞানে (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন। সজীব শেখ বলেন, তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান হাসপাতালে গিয়ে আহত শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর পরিবারের হাল ধরতে ওই বছরই তাঁর মাকে নিয়ে তিনি সচিবালয় ও মন্ত্রী শাজাহান খানের বাড়ি মাদারীপুরে গিয়ে দেখা করেন। কিন্তু চাকরি আর হয়নি।

সজীব শেখের মা শাহানা বেগম বলেন, ছেলেটার হাত ভেঙেছে। সাবেক নৌমন্ত্রী তাঁর আশ্বাস মনে রেখে চাকরি দিলে পরিবারটা ভালোভাবে চলতে পারত।

শিক্ষার্থী জয়ন্তী রানী দাসের দুই পা থেঁতলে গিয়েছিল। তিনি বলেন, সেই দুঃসহ স্মৃতি ভোলার মতো নয়। সেদিন বাসটির নিচে পড়ে গিয়েছিলেন। সহপাঠী প্রিয়াংকা ছিল তাঁর ওপরে। তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। গত বছরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। বতর্মানে রাজধানীর শান্তিনগরের হাবীবুল্লাহ বাহার ডিগ্রি কলেজে মার্কেটিং প্রথম বর্ষে পড়েন। তিনি সপরিবার ভাটারার কালীমন্দিরের পেছনে থাকেন।

বাসের চাপায় শিক্ষার্থী তৃষ্ণা রানী দাসের ডান পা ভেঙে যায়। ডান হাত ও বাঁ হাতের হাড় ফেটে গিয়েছিল তাঁর। অসুস্থ অবস্থায় ছয় মাস তাঁকে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে একটু আধটু হাঁটতে শুরু করেন তিনি। ওই অবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। বর্তমানে তিনি সিদ্ধেশ্বরী কলেজে বিবিএ (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়ছেন।

তৃষ্ণা রানী দাস বলেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এখনো হাত, পা, কোমর ও ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা। পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটার পর পা ব্যথা হয়। হাত দিয়ে কিছু তুলতে গেলে খুব কষ্ট হয়। গত বছর বহু কষ্ট করে কিছুদিন কলেজে গিয়েছিলেন। এখন করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ রয়েছে।

বাসের চাপায় আরেক শিক্ষার্থী মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। তিনি এখন ট্রমাটাইজড। তাঁকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। চিকিৎসকের পরামর্শে তাঁকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রমিজউদ্দিন কলেজের অধ্যক্ষ তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছেন। তবে ওই শিক্ষার্থীর বাবা তার ছেলে বা তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।


এ ছাড়া ওই ঘটনায় আহত শিক্ষার্থী রুবাইয়া আক্তার, মেহেদী হাসান, রাহাত হোসেন, ইমন চৌধুরী সোহেল রানা সুস্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে।

যোগাযোগ করা হলে তৎকালীন নৌমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি চাকরি পেতে হলে আবেদন করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। লিখিত পরীক্ষায় পাস করলে তাঁদের জন্য তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন।