একজন চিকিৎসকের অন্য রকম স্বপ্ন

মোরশেদ আলী
মোরশেদ আলী

চোখের সামনে দেখেছেন অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টের রোগীদের ছটফট করতে। অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে তাঁর সামনে।

কোভিড-১৯ হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক মোরশেদ আলী দেখেন, গ্রামে বা মফস্বলে রোগীদের কষ্ট আরও বেশি। শহরে হয়তো কোথাও অক্সিজেনের সুবিধা মেলে। কিন্তু উপজেলার হাসপাতালে ছোট্ট একটি সিলিন্ডার পাওয়াও যেন স্বপ্নের মতো।

এই অবস্থা দেখে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাসিন্দা মোরশেদ আলী সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা ভাবলেন। সেই ভাবনা থেকে সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন বসানোর স্বপ্ন দেখলেন তিনি।

ফেসবুকে স্বপ্নের কথা তুলে ধরেন মোরশেদ আলী। পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে অনুদান চাইলেন। সেই আহ্বানে ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ, হতদরিদ্র থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে এসেছেন। কেউ দিয়েছেন টাকা, আবার কেউ চিকিৎসা সরঞ্জাম।

ইতিমধ্যে অনুদানের প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০ শয্যার সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৩০ শয্যাসহ অপারেশন থিয়েটার এখন কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের আওতায় চলে এসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হাই–ফ্লো নাজাল ক্যানুলা মেশিন, দুটি হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) বেড, মনিটর, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষাসামগ্রী। এখন বাকি আছে অত্যাধুনিক একটি প্যাথলজি ল্যাব স্থাপন ও উন্নত মানের আধুনিক কিছু চিকিৎসার সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজ।

কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন বসানোর গল্প বলতে গিয়ে মোরশেদ আলী দুটো ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘জুন মাসে সাতকানিয়ার বাজালিয়া এলাকার এনামুল হক নামের এক শিক্ষক শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি সেখানে অক্সিজেনের সুবিধা পাচ্ছিলেন না। খবর পেয়ে আমার নিজের একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিজেই বহন করে নিয়ে গিয়ে তাঁকে সেবা দিয়েছিলাম। এরপর সাতকানিয়ার আরেক করোনা রোগী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রেজাউর রহমান শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ডাক্তারের পরামর্শ ছিল, তাঁকে হাই–ফ্লো নাজাল ক্যানুলা মেশিন দিয়ে অক্সিজেন দিতে হবে। বিষয়টি জানার পরপর সাহায্য চেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই। সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি ১০টি বড় আকারের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ওই ছাত্রের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। শিক্ষক এনামুল হক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউর দুজনই সুস্থ হন। এসব ঘটনা দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই। স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, সাতকানিয়াসহ মফস্বলের কিছু হাসপাতালে সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই মানুষের অনুদানের টাকায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইনসহ উন্নত চিকিৎসাসেবা চালু করা সম্ভব।’

মোরশেদ আলী বলেন, সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন বসানোর জন্য সরকারি সাহায্যের প্রয়োজনই হয়নি। সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা ও সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা পর্যন্ত অনুদান পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে ১৪৩ জন মানুষ ও পাঁচটি সংগঠন অর্থসহায়তা ও সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আরও অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, নুসাইবা নুজহাত নামের আট বছরের এক শিশুও দুই ঈদের জমানো দুই হাজার টাকা মানুষের চিকিৎসার জন্য অনুদান হিসেবে দিয়েছে।

স্থানীয় লোকজন জানান, প্রায় সাড়ে চার লাখ বাসিন্দার এই উপজেলায় উন্নত চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। এখন রোগীদের আর শহরে ছুটে যেতে হবে না। উপজেলা হাসপাতালেই ভালো চিকিৎসা পাওয়া যাবে।

সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবদুল মজিদ ওসমানী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে ব্যক্তি উদ্যোগে এ ধরনের অক্সিজেন লাইন বসানোর কাজ খুব একটা চোখে পড়ে না। সৎ সাহস, আত্মবিশ্বাস ও চেষ্টা থাকায় এই অসাধ্যকে সাধন করে দেখিয়েছেন মোরশেদ আলী।

মোরশেদ আলী ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি হাসপাতালে যোগ দেন। ২০১৬ সালে সার্জারিতে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তাঁর আট বছর ও চার বছর বয়সী দুটি মেয়ে আছে। তিনি এখন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন বসানোর কাজ করছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকার হাসপাতালগুলোতে এই সেবা চালু করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।