জাফলংয়ে সন্ধ্যায় পাথর লুটের চেষ্টা, জব্দের পর রাতেই নিলামে বিক্রি

পাহাড়ি ঢলে জমা হওয়া জাফলংয়ের এই পাথরগুলো লুট করার চেষ্টা চলছিল। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পাথরগুলো জব্দ করে রাতে উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করে গোয়াইনঘাট প্রশাসন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পিয়াইন নদের তীরে। ছবি: প্রথম আলো
পাহাড়ি ঢলে জমা হওয়া জাফলংয়ের এই পাথরগুলো লুট করার চেষ্টা চলছিল। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পাথরগুলো জব্দ করে রাতে উন্মুক্ত নিলামে বিক্রি করে গোয়াইনঘাট প্রশাসন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পিয়াইন নদের তীরে। ছবি: প্রথম আলো

সিলেটের জাফলংয়ে পিয়াইন নদ দিয়ে পাহাড়ি ঢলে জমা হয়েছে প্রায় এক লাখ ঘনফুট পাথর। গত রোববার সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম পরিদর্শন করে পাথরগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। দুদিনের মাথায় গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পাথরগুলো লুট করার তৎপরতা শুরু করে একটি চক্র।

খবর পাওয়া মাত্র জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক টাস্কফোর্সের অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে টাস্কফোর্সের অভিযান হয়। হাতেনাতে চারজনকে আটক করে জব্দ করা হয় পাথর। রাত নয়টার দিকে জব্দ করা পাথর ঘটনাস্থলে উন্মুক্ত নিলাম ডাকের মাধ্যমে সাড়ে নয় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

জাফলং সীমান্তের শূন্যরেখার (জিরো পয়েন্ট) কাছে এ ঘটনা ঘটে। জাফলংসহ পাথরকোয়ারি এলাকায় সাধারণত দিনের বেলা টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ অভিযান হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে জমা হওয়া পাথর লুট ঠেকাতে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত এ রকম অভিযান গোয়াইনঘাটে প্রথম হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে সিলেটে সুরমা নদী, কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদ ও কানাইঘাটের লোভা নদীর তীরে অবৈধভাবে মজুত করা অর্ধশত কোটি টাকার পাথর লুট ঠেকিয়েছে প্রশাসন।

উপজেলা প্রশাসন জানায়, পাহাড়ি ঢলের পানি কমায় জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টের কাছে জমা হওয়া পাথর জেগে ওঠে। ঢলের পাথরগুলো সংরক্ষণ করতে পারলে জাফলংয়ের পর্যটন সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় পাথরগুলো রক্ষায় একটি কমিটি করে স্থানীয় প্রশাসন। গত রোববার বিকেলে জেলা প্রশাসক পরিদর্শন করে পাথর সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দেন। এর এক দিন পরই লুটের চেষ্টা হয়। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে চারজনকে আটক করা হয়।

গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুস সাকিব জানান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এ কে এম নূর হোসেন, বিজিবির সংগ্রামপুঞ্জি বিওপির (সীমান্ত ফাঁড়ি) ক্যাম্প কমান্ডার নওশের আলীসহ গোয়াইনঘাট থানা ও জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের সমন্বয়ে গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অভিযান হয়। পাথর লুট করার সময় হাতেনাতে আটক চারজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জব্দ করা পাথর রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রকাশ্যে নিলাম ডাক দিয়ে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

অভিযান শেষ করে রাত সাড়ে ১০টায় ইউএনও প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিসি স্যার রাতে অভিযান চালানোর নির্দেশ না দিলে লুট করা পাথর জব্দ করা সম্ভব হতো না। তা ছাড়া সেখানে জমা হওয়া সব পাথর রাতেই বোধ হয় সাবাড় হতো।’

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সিলেটে নদ-নদীতে পাহাড়ি ঢল নামার সুযোগে একশ্রেণির পাথর কারবারি নানা অজুহাতে অবৈধভাবে পাথর যত্রতত্রভাবে মজুত করে বিক্রি করেন। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটে। এবার অবৈধ এই তৎপরতা বন্ধ করতে পাহাড়ি ঢল নামার শুরু থেকে তৎপর প্রশাসন। ৯ জুলাই কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদের তীরে প্রথম অভিযানে অবৈধভাবে মজুত করা পাথর জব্দ করে নয় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়।

১৪ জুলাই জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দ্বিতীয় অভিযানে সুরমা নদীর তীরে অবৈধভাবে মজুত করা পাথর জব্দ করে ৯৪ লাখ ৩০ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি করা হয়। সবচেয়ে বড় অভিযান হয় ইজারাবহির্ভূত কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া পাথরকোয়ারিসহ লোভা নদীর তীরে।

গত ১৮ জুলাই সেখানে অভিযান চালিয়ে এক কোটি ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। এই পাথরগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিলাম ডাকে বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এর মধ্যে প্রথম নিলাম ডাকে দর উঠেছিল প্রায় ৩৪ কোটি টাকা। আরও দর পেতে তৃতীয় দফা নিলাম ডাক দেওয়া হয়েছে।

৯ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত পৃথক চারটি অভিযানে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পাথর লুট ঠেকানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের সক্রিয়তায়। অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর জব্দ করা ও নিলামে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ার ঘটনা সিলেটের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সর্বশেষ জাফলংয়ে রাতে তাৎক্ষণিক অভিযানে পাথর লুট ঠেকানো প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই পাথরগুলো সাম্প্রতিক পাহাড়ি ঢলে জমা হয়েছিল। জাফলং বিখ্যাত একটি পর্যটন এলাকা, তাই পাথরগুলো সংরক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়ে এসেছিলাম। এর মধ্যে খবর পাই রাতে লুট করতে তৎপর একটি চক্র। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে পাথর লুটপাট ঠেকানো গেছে। স্থানীয় প্রশাসনকে লুটপাট চক্রের পেছনে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’

করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে প্রশাসন সবদিক সামাল দিয়ে এ কাজ করছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘দিনে ও রাতে পাথর পাহারা দেওয়া কিন্তু জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসনের কাজ নয়। এসব নিয়ে যাদের বেশি সক্রিয় থাকার কথা, তারা সক্রিয় নয় বলে আমরা প্রশাসনিক কাজের মধ্যেও এ কাজটি করছি। সিলেট, কোম্পানীগঞ্জ, লোভাছড়া ও জাফলংয়ে চারটি অভিযানের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পাথর লুট ঠেকানো হয়েছে। যেখান থেকে সরকার কোনো টাকা পেত না।’