পদ্মায় বিলীন আলো ছড়ানো স্কুলটি

’৭৮ বছরের পুরোনো এই স্কুলের সঙ্গে চরাঞ্চলের মানুষের ছিল অনেক মধুর স্মৃতি। সেটি চোখের সামনে পদ্মায় তলিয়ে গেল। আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না। এখন কোথায় নিয়ে যাব বিদ্যালয়টি।’

আজ বুধবার দুপুরে ৮১ নম্বর বসাকের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি পাকা ভবন পদ্মা নদীতে বিলীন হওয়ার পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিলেন প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন।
বিদ্যালয়টির অবস্থান শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা ইউনিয়নের বসাকের চর মৌজায়।

পদ্মা নদীর কারণে বিচ্ছিন্ন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের একটি মৌজা বসাকের চর। দুর্গম ওই চরের চারদিকে পদ্মা নদী। ১৯৪২ সাল থেকে দুর্গম এই চরের শিশুদের মধ্যে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে স্কুলটি। গত বছর বিদ্যালয় থেকে নদীর দূরত্ব ছিল ৫০০ মিটার। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় গত বছর থেকেই বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছিল। কিন্তু আর শেষ রক্ষা হলো না। আজ দুপুরে বিদ্যালয়ের একটি ভবন পদ্মায় তলিয়ে গেল। বিদ্যালয়ের দ্বিতল ভবনটিও যেকোনো সময় বিলীন হয়ে যাবে। ভাঙন তীব্র থাকায় বসাকের চর গ্রামের ১১০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

গতকাল স্কুল ভবনটি থেকে পদ্মার দূরত্ব ছিল ২০ মিটার। আজ সকালে ভাঙন শুরু হয়। বেলা ১১টার দিকে ভবনটি ভাঙতে থাকে। বেলা দুইটার দিকে পুরো ভবনটি পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৯৪২ সালে বসাকের চর গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপন করা হয়। বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আছেন চারজন শিক্ষক। এর আগেও বিদ্যালয়টি কয়েক দফা ভাঙনের শিকার হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে বিদ্যালয়টি পদ্মায় বিলীন হয়। এরপর বসাকের চরের নতুন স্থানে ৪০ শতাংশ জমির ওপর ২০০৭ সালে বিদ্যালয়টি নতুন ঠিকানা পায়। ঘূর্ণিঝড়ে আধা পাকা ভবন বিধ্বস্ত হলে ২০১২ সালে একটি দ্বিতল ভবন ও ২০১৭ সালে একটি একতলা ভবন নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

চরআত্রা ইউনিয়নের বাসিন্দা তৌহিদ মুন্সি জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। বিদ্যালয়ের ভবন ভাঙনের খবর পেয়ে এলাকায় ছুটে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যালয়টি চরাঞ্চলের বাতিঘর ছিল। চোখের সামনে এটি তলিয়ে যেতে দেখে শুধু চোখের পানি ফেলেছি। আমার বাবা ও বড় ভাই এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁদের মৃত্যুর পর এখন ভাবি চেয়ারম্যান। আশা ছিল বিদ্যালয়টি রক্ষা করতে পারব। কিন্তু তা আর হলো না। সবার চোখের সামনেই একতলা ভবনটি পদ্মায় হারিয়ে গেল।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ ধরে এ এলাকার ভাঙন তীব্র ছিল। পরিস্থিতি বেশি খারাপ দেখে গতকাল স্কুলের আসবাব পাশের সরকারকান্দি গ্রামের একটি উঁচু স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়ন্তী রুপা রায় বলেন, বিদ্যালয়টির আসবাব যাতে নষ্ট না হয়, এখন সে চেষ্টা করা হবে। আর আশপাশে ভাঙনের ঝুঁকি নেই, এমন জায়গায় বিদ্যালয়টি স্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যাতে কষ্ট না হয়, সে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিদ্যালয় ভবনটি বিলীন হওয়ার খবর পেয়ে বসাকের চরে আসেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নড়িয়ার চরআত্রা ও নওপারা ইউনিয়নের ভাঙন রোধ করার জন্য সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। বিদ্যালয়ের আশপাশসহ বিভিন্ন স্থানে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না, ভবনটি আর রক্ষা করতে পারলাম না।

স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রকৃতির কাছে হেরে গেছি। ওই বিদ্যালয়টির নতুন ঠিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য জমির সন্ধান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, নদীতে তীব্র স্রোত থাকায় জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট, ওকিলউদ্দিন মুন্সিকান্দি, বড়কান্দি ইউনিয়নের দুর্গাহাট, নাজিম উদ্দিন ব্যাপারীকান্দি, নড়িয়ার ঘরিসার ইউনিয়নের চরমোহন, বাংলাবাজার, চরআত্রা ইউনিয়নের বসাকের চর, কীর্তিনাশা নদীর নড়িয়ার মোক্তারের ইউনিয়নের ঢালীপারা, সদরের পালং ইউনিয়নে কোটাপারা, ডোমসার ইউনিয়নের মুন্সিরহাট এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হকের নির্দেশে ওই স্থানগুলোতে ভাঙন রোধের জন্য বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।