সেতুর ওপর ৭০ পরিবার

বন্যার পানিতে বাড়িঘর নিমজ্জিত। তাই মানুষ সেতুর ওপর পালিথিনের ছাউনি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার একাব্বর হোসেন সেতুতে। ছবি: প্রথম আলো।
বন্যার পানিতে বাড়িঘর নিমজ্জিত। তাই মানুষ সেতুর ওপর পালিথিনের ছাউনি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার একাব্বর হোসেন সেতুতে। ছবি: প্রথম আলো।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদরের পোস্টকামুরী পূর্ব পাড়া (সওদাগরপাড়া) এলাকার বাবলী। বন্যার পানিতে ঘর ডুবে যাওয়ার পর তিনি স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে প্রায় ১০ দিন আগে আশ্রয় নেন একাব্বর হোসেন সেতুর ওপর।

বাবলীর স্বামী আসাদ গ্যাসলাইটার ও ছাতা মেরামত করেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য কয়েক মাস ধরে তেমন কাজ নেই। তার ওপর বন্যা। বাড়ি ছেড়ে সেতুর ওপর ঠাঁই নেওয়ার পর কোনোরকমে সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না–খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা।

বাবলী জানান, ঘর ছেড়ে আসার পর দিনে দুবেলা খান তাঁরা। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকালে দোকান থেকে ‘বনরুটি’ কিনে তিন সন্তানকে নিয়ে খেয়েছেন। আর বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে আলুভর্তা আর ভাত খাচ্ছেন। রাতে পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। প্রতিটা দিনই কাটছে বৃহস্পতিবারের মতো। বাবলীদের মতো একই পরিস্থিতিতে পড়ে ওই এলাকায় বসবাসরত প্রায় ৭০টি পরিবারের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সেতুটির ওর। সবারই দিন কাটছে মোটামুটি বাবলীদেরই মতো। বন্যার কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দু-একটি সাইকেল, ভ্যান ছাড়া সেতুটি দিয়ে যান চলাচল প্রায় বন্ধ রয়েছে। এ কারণে তারা সেতুটিতে আশ্রয় নিতে পেরেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বংশাই নদের পাশে দুই শতাধিক দরিদ্র মানুষের বাস। যাদের অধিকাংশেরই পেশা ছাতা ও গ্যাসলাইটার মেরামত। আর ফেরি করে কাচের জিনিস বিক্রি করা। অনেকে অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাঁরা মূলত বেদে পরিবারের বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

সেতুটির ওপরে দুই পাশে পলিথিনে মোড়ানো প্রায় ৭০টি ছোট ছোট পৃথক ছাউনি রয়েছে। সেখানে তারা আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়স্থলে ছোট ছোট শিশুরা খেলা করছে। অনেক শিশু চৌকিতে ঘুমাচ্ছে। বড়দের অনেকে ক্লান্ত শরীরে গবাদিপশুর সঙ্গে একই ছাউনিতে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন।

মাহাবুব মিয়ার ছেলে শিশু রতন ঘুমাচ্ছিল একটি চৌকিতে। পাশে বসে থাকা শিশুটির দাদি সোনাভানু বলেন, ‘ও যে শান্তিতে একটা ঘুম দিছে না। কী যে ভালো লাগতাছে। পরাই ১০ দিন ধইর‌্যা এনে আইছি। খ্যায়া না খ্যায়া দিন কাটাইতাছি। একবার একজনে আয়্যা কয়ডা চ্যাল দিল। তারপর আর কেউ খবর নিল না। কাম নাই। ভালো খাওন নাই। খালি ঘুম আর ঘুম। খালি প্যাটে তো ঘুমও আহে না।’

গরু-ছাগল নিয়ে সেতুটিতে আশ্রয় নিয়েছেন ছমন মিয়া। তিনি সেই গবাদিপশুর সঙ্গে একই পলিথিনের ছাউনিতে ঘুমাচ্ছিলেন।

এদিকে মির্জাপুরে বৃহস্পতিবারও বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কুমুদিনী হাসপাতালের ভেতরে নৌকায় করে রোগীদের পারাপার করা হচ্ছে। চিকিৎসক, সেবিকাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই নৌকা ব্যবহার করছেন। শনিবার পবিত্র ঈদুল আজহার দিন নামাজ শেষে পশু কোরবানি নিয়েও মানুষ চিন্তিত।

গোড়াইল গ্রামের লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমাদের সমাজের সবাই একত্রে একটি বাড়ির উঠানো কোরবানি করতাম। কিন্তু এ বছর বন্যার কারণে সব পশু এক জায়গায় নেওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য সবাই খুবই কষ্টের মধ্যে রয়েছে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুল মালেক বলেন, সেতুর ওপর আশ্রয় নেওয়া লোকদের সরকারিভাবে কিছু সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আরও সহায়তা দেওয়া হবে।