করোনাকাল জীবন যেমন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

এই এক অদ্ভুত সময়! রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন কিংবা ঝরো ঝরো বর্ষা—যা–ই থাকুক না কেন, বাইরে যাওয়া বারণ! শুরুতে লকডাউন, অফিস ছুটি, ঘরবন্দী জীবনটাকে বেশ ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল ইঁদুর-দৌড় জীবনটাতে এবার একটু দম নেওয়া যাবে আয়েশ করে...কর্মজীবী মাকে হঠাৎ বাসায় পেয়ে ছোট বাচ্চাটা ও ভীষণ খুশি! আনন্দে ব্যাঙাচির মতন সারা দিন লাফাতে থাকে...কর্তা করে নানা রকম মুখরোচক খাবারের আবদার। আমিও খুশি মনে করে দিই। ঘরের কাজ আর বাচ্চার সঙ্গে খেলতে খেলতে সময়টা ভালোই কাটছিল। শুধু প্রতি সন্ধ্যায় আমার মন খারাপ হতো ভীষণ! বাবার বাড়ি যাই না কত দিন! বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা ছলছলে চোখে অপেক্ষা করেন মেয়ে তাঁর কখন ফেরে...।

প্রতি সন্ধ্যায় মনে হতো আর কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে? দূর প্রবাসে থাকা বড় বোনটার সঙ্গে আর কি কখনো দেখা হবে? কিংবা আদরের ছোট বোনটার সঙ্গে অকারণে খুনসুটি, ঝগড়া আর কি হবে! পুরো পৃথিবী তো করোনা–ঝড়ে টালমাটাল। অর্থনীতির সব হিসেব–নিকেশ গেছে পাল্টে। চারদিকে সব অনিশ্চয়তা, আর কখনো কি সব স্বাভাবিক হবে?

টিভির সংবাদ দেখা বাদ দিয়েছি। প্রতিদিন মৃত্যুর পরিসংখ্যান-গ্রাফের প্যারামিটার বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ডের পালপিটিশন। মনে হয় চারদিক থেকে মৃত্যুদূত আজরাইল এসে চেপে ধরছে আমাকে। দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠি, হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ি, কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাই পরম করুণাময়ের কাছে....।

এ এক অদ্ভুত সময়! হয়তো আত্মশুদ্ধির, পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ার....ইদানীং সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে জানতে পারছি করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির কথা। যা সত্যিই হতাশার...চারদিকে শুধু হতাশা আর হতাশা, আশার আলো হারিয়ে গেছে যেন নিকষ কালো অন্ধকারে।

এরই মধ্যে এসে গেল রোজার ঈদ। প্রতিবছর রোজার ঈদ নিয়ে কত প্রস্তুতি। নতুন ড্রেস-অতিথি আপ্যায়ন কিচ্ছু নেই এবার। ভিডিও চ্যাটে বাবা–মাকে ঈদের সালাম জানাই, বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই...এই ঈদ অন্য রকম। এই দিনে নেই ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার তাড়া, নেই বড়দের পেছনে ছোটদের সালাম করতে যাওয়ার লাইন আর সেলামি নেওয়ার হুড়োহুড়ি! এই ঈদে শুধুই অপেক্ষা পৃথিবী সুস্থ হওয়ার...।

ঈদের পরেই আমার অফিস খুলে গেল। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয় এই বুঝি মৃত্যুপরোয়ানা হাতে নিয়ে বের হচ্ছি! এ কেমন সময়?

চারদিকে এত হতাশার মাঝে সত্যি কি আশার আলো হারিয়ে গেছে? মন বলে কই না আছে তো! ওই যে উচ্ছল শিশুটি যে ঘরবন্দী আছে আজ প্রায় চার মাস কিন্তু তাতে কোনো বিশেষ মাথাব্যথা নেই তার। সারা দিন আনন্দে-গানে-দুষ্টুমিতে মেতে রয়েছে বাবুটা। তার কাছে সত্যি শেখার আছে অনেক কিছু! আসলে অকারণে দুশ্চিন্তা-বিষণ্নতার কোনো মানে নেই। ছোট্ট জীবনটায় যখন যে অবস্থায় থাকি না কেন হাসি-আনন্দে কাটানোর মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ!

*গুলশান, ঢাকা