ঈদে আনন্দ নেই, আছে শুধু দীর্ঘশ্বাস

সিরাজগঞ্জ সদরের পাঁচঠাকুরী গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারানোর পর গবাদিপশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে একটি পরিবার। বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা ছবি। প্রথম আলো
সিরাজগঞ্জ সদরের পাঁচঠাকুরী গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারানোর পর গবাদিপশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে একটি পরিবার। বৃহস্পতিবার বিকেলে তোলা ছবি। প্রথম আলো

যমুনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনে অনেকের বসতভিটা একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। কয়েকজনের বসতভিটার বেশির ভাগ অংশ নদীগর্ভে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ঘর ও ঘরের মালামাল নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ মালামাল ও ঘর—কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। আশ্রয় নিয়েছেন সড়ক ও বাঁধের ওপর। কাল বাদে পরশু ঈদ। ঈদ ঘিরে অনেকের মনে আনন্দ থাকলেও তাঁদের মনে সীমাহীন কষ্ট। তাঁরা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নদীভাঙনকবলিত পাঁচঠাকুরী গ্রামের মানুষ। গত শুক্রবার যমুনার তীব্র ভাঙনে এই গ্রামের আড়াই শ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে পাঁচঠাকুরী গ্রামের নদীভাঙনকবলিত জামে মসজিদের কাছে কথা হয় ভাঙনে ঘরহারা আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। নদীভাঙনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে তিনি বললেন, ‘গত শুক্কুরবার দুপুর তইক্যা নদী বাঙা শুরু ওইলো। হুনলাম কয়েক বাড়ি বাঙার পরেই আমাগোর বাড়ি পড়বো। তাই ছওয়ালপালেক ডাক দিয়্যা নাও ভাড়া কইর‌্যা ঘরের জিনিসপত্র তুইলব্যার কইল্যাম। কিন্তু কোন লাব (লাভ) ওইলো না। পুবের মুড়া থ্যাইহ্যা (পূর্ব দিক থেকে) ভাঙন শুরু অয়া আধাঘণ্টার মধ্যে মেলা বাড়ি ডাইব্যা গেলো। কাইন্দাকাইট্যা বাড়িঘর থুইয়া মানুষগুলান দোড়ায়া আইসত্যাছে। ওই দেইহে আমরাও সবকিছু হরাইব্যার পাইরল্যাম না। পানি আর নদীর হাতে (সঙ্গে) যুদ্ধ কইর‌্যা কিছু মালামাল টানে তুইল্যা নিয়্যা কোন রহমে ওয়াপদার উপর আচি।’

ঈদের বিষয়ে জানতে চাইলে আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমগোরে (আমাদের) কোন ঈদ নাই, বাড়িঘর নাই, আশ্রয় নাই, সংসার চলবো কী দিয়্যা তার বন্দোবস্ত নাই। যমুনায় সব নিয়্যা গেছে। অ্যাহন আমরা নিঃস্ব। এই বাড়ি আমার বাপ দাদার। এই প্রথম আমার বাড়ি নদীত বাঙল। আগে কালে মুরুব্বিরা কইছে আগুনে পুইড়লে তা-ও বিটামাটি (ভিটামাটি) থুইয়্যা যায়, যমুনার থাবায় কিচ্ছু থাহে না—কতাডো (কথাগুলো) এবার হাড়ে হাড়ে টের পাইলাম।’

নদীগর্ভে চলে যাওয়া বসতভিটার সামনে বসে আহাজারি করছিলেন মাহবুবুর রহমান শেখ। তিনি বলেন, ‘যমুনায় আমার সবকিছুই নিয়্যা গেলো। এ্যাহুন ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতি নিয়্যা নয়জনের সংসার কীভাবে চইলবো জানিনা। পাঁচদিন ধইর‌্যা ওয়াপদার পাশে এক আত্মীয় বাড়ির বারান্দায় কোন রহমে আচি। অ্যাহুন (এখন) পর্যন্ত কোনো থাকার জায়গা পাই নাই।’

নদীতে বসতভিটা হারিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ঝর্না বেগম, রোমেছা খাতুন ও মুক্তি খাতুন। তাঁরা সিমলা স্পার বাঁধের গোড়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছাপরা তুলে বাস করছেন। বৃহস্পতিবার সেখানে গেলে ঝর্না বেগম বলেন, ছয় সদস্যের সংসারে ঈদের দিনে তাঁদের ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই।

ছোনগাছা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বলেন, ‘নদীভাঙনে পাঁচঠাকুরী গ্রামের আড়াই শ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি পরিবার তাদের ঘর, আসবাব—কোনো কিছুই সরানোর সুযোগ পায়নি। ভাঙনে এই পরিবারগুলো সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা পরিষদে পাঠিয়েছি। তাদের পুনর্বাসনে সরকারি সহায়তার আবেদন করা হয়েছে। এ রকম নদীভাঙন আগে কখনো দেখিনি। এখনো হুমকিতে রয়েছে আশপাশের কয়েকটি গ্রাম।’

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ১ জুন সিমলা স্পারের বাঁধের প্রায় ৭০ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধটি সংস্কার করা হলেও তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাঁধের বেশির ভাগ নদীগর্ভে চলে গেছে। গত শুক্রবার বিকেল থেকে সিরাজগঞ্জ সদরের সিমলা ও পাঁচঠাকুরী গ্রামে হঠাৎ ভয়াবহ নদীভাঙন শুরু হয়। ভাঙনের তীব্রতায় নিমেষেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় দুই শতাধিক বসতভিটা, মসজিদসহ আবাদি জমি।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, সিমলা স্পার বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় যমুনার স্রোত গতি পরিবর্তন করে সরাসরি বাঁধে আঘাত করছে। এ কারণে পানির প্রবল স্রোতে হঠাৎ করেই নদীভাঙন শুরু হয়েছে। নদীভাঙন রোধে কাজ চলছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকার অসীম কুমার প্রথম আলোকে বলেন, এরই মধ্যে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই শ পরিবারকে শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। ওই সহায়তার পাশাপাশি তাদের জন্য ২৫টি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং বিশুদ্ধ পানির জন্য ২০টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে ঘর তৈরির জন্য ঢেউটিন পেতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।