প্রিয়জনদের ছাড়া এবারও জিয়াউরের বিবর্ণ ঈদ

বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান।

রমজানের ঈদের আগে ও পরে প্রতিদিন বরিশাল নৌবন্দরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। তখন ঈদে গ্রামে ফেরা মানুষের আসা-যাওয়ার দৃশ্য তাঁর মন ভারাক্রান্ত করত। রাতে ঘরে ফিরে নীরবে চোখ বেয়ে জল গড়াত। ভেবেছিলেন, কোরবানির ঈদটা হয়তো প্রিয়জনদের সঙ্গে উদযাপন করতে পারবেন। কিন্তু সে ইচ্ছাও পূরণ হলো না। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এবারও ঈদের দিন মাঠে থাকতে হবে জিয়াউর রহমানকে।

ছয় মাস ধরে মা-বাবা আর বোনদের থেকে দূরে আছেন জিয়াউর। বরিশাল জেলা প্রশাসনের এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে এক দিনের জন্যও ছুটি পাননি। আসছে কোরবানির ঈদটাও পরিবারের সান্নিধ্য ছাড়াই কাটাতে হবে। এই পুরোটা সময় অন্যদের সঙ্গে তিনিও করোনাভাইরাস প্রতিরোধের কাজ করে চলেছেন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে।

জিয়াউর রহমান জানালেন, গত ঈদে মনটা খুবই বিষণ্ন ছিল। অনেক দিন মা-বাবা আর বোনদের মুখ দেখি না। মা ফোন করে শুধু কাঁদতেন। বলতেন, ‘তোর সঙ্গে কবে দেখা হবে আবার?’ মায়ের এ প্রশ্ন শুনে নীরবে চোখের জল আসত। মায়ের আকুতি শুনে ওপাশে বাবা ফোন নিয়ে সাহস দিয়ে বলতেন, ‘বাবা, দেশের এই দুর্যোগে তুমি মানুষের জন্য কাজ করছ, এটা তোমার অনেক বড় সৌভাগ্য। বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ একসঙ্গে উদ্‌যাপনের সুযোগ আসবে। তুমি মন দিয়ে দেশের ও অসহায় মানুষের জন্য কাজ করো।’ বাবার কথা শুনে মনের সব মেঘ কেটে বুকটা সাহসে ভরে ওঠে। বাবার এই সাহসই এখন তাঁর কাজের শক্তি।

জেলা প্রশাসন জানায়, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে আছেন জিয়াউর রহমান। তরুণ এই ম্যাজিস্ট্রেট চার মাস ধরে বরিশাল নগরের করোনা প্রতিরোধে কাজ করতে গিয়ে এখন সব মহলে আলোচিত ও প্রশংসিত। চার মাসে তিনি পরিচালনা করেছেন ৫০টির বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত।

মার্চের মাঝামাঝি জিয়াউরকে প্রথম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব দেন বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান। একদিকে করোনার আতঙ্ক, অন্যদিকে জীবনে প্রথম ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর কাঁধে ওঠায় চিন্তায় পড়েন তিনি। এরপর নিজেই সাহস সঞ্চয় করে নগরের বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক-স্যানিটাইজারের কৃত্রিম সংকট ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে শুরু করেন অভিযান। প্রথম দিনের সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর টানা কয়েক দিনের সফল অভিযানে নগরের মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভীতির বার্তা ছড়িয়ে দেন জিয়াউর। হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া মাস্ক-স্যানিটাইজার আবার সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়। দ্রব্যমূল্যের বাজার চলে আসে নাগালে। জেলা প্রশাসক তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হন। জিয়াউর রহমানও কখনো ভেজাল ও নকল ওষুধের দোকানে, কখনো বাজারে, কখনো নিত্যপণ্যের আড়তে আবার কখনো লঞ্চঘাটে যাত্রী ভোগান্তি দূর করতে ছুটে চলেছেন। কখনো আবার রাত-বিরাতে করোনায় কাজ হারানো কোনো অসহায় পরিবারের কাছে ছুটে যাচ্ছেন খাদ্যপণ্য সহায়তা নিয়ে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার ছেলে জিয়াউর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য ফসিউর রহমান ও গৃহিণী সাজেদা বেগমের এক ছেলে আর পাঁচ মেয়ের মধ্যে সবার বড়। ২০০৯ সালে এসএসসি পাসের পর ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে ৩৭তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ জিয়াউর ছয় মাস প্রশিক্ষণ শেষে গত ডিসেম্বরে বরিশাল জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন। দু-তিন মাস না পেরোতেই দেশে শুরু হয় ভয়াল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জিয়াউর রহমানসহ অন্য সব ম্যাজিস্ট্রেটই দায়িত্বের ব্যাপারে খুবই অঙ্গীকারবদ্ধ এবং পরিশ্রমী। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা, দুঃখ-কষ্ট লাঘব, সংক্রমণ রোধসহ সব কাজে শুরু থেকে তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ব্যাপক প্রশংসিত। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই বরিশাল জেলা প্রশাসন করোনা প্রতিরোধে সফল হয়ে সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

গত ঈদে মা-বাবা আর বোনদের জন্য কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে উপহার পাঠিয়েছিলেন জিয়াউর। তাঁরাও তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মনটা পড়ে ছিল তাঁদের কাছে। জিয়াউর বললেন, ‘আমার মনের অবস্থা দেখে ডিসি স্যার বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘‘দ্যাখো মন খারাপ কোরো না। এখন আমরা একটি পরিবার। এবার আমরা এই পরিবারের সবাই একসঙ্গে ঈদ করব। এটা একটি যুদ্ধক্ষেত্র, এই যুদ্ধে আমরা জিতলে দেশ ও মানবতা জিতে যাবে।”’