নাজমুলের পর গ্রেপ্তার ফরিদপুরের শ্রমিক লীগ নেতা বিল্লাল

নাজমুল ইসলাম খন্দকার ও বিল্লাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
নাজমুল ইসলাম খন্দকার ও বিল্লাল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মানি লন্ডারিং মামলায় ফরিদপুরে এবার গ্রেপ্তার হয়েছেন শ্রমিক লীগের নেতা বিল্লাল হোসেন (৫৪)। শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ফরিদপুর শহরতলির হাড়োকান্দি এলাকার নিজ বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ফরিদপুর ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুনীল কর্মকার বলেন, ঢাকার কাফরুল থানার এক মানি লন্ডারিং মামলায় বিল্লালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করে সিআইডি। বিল্লালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সিআইডির চাহিদা অনুযায়ী।

বিল্লাল গ্রেপ্তার হওয়ার ঘন্টা দুয়েক আগে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেবিকে (৬১) গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডির চাহিদা অনুযায়ী নাজমুলকেও মানি লন্ডারিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

শ্রমিক লীগ নেতা বিল্লাল ফরিদপুর শহরতলির হাড়োকান্দি এলাকার বাসিন্দা মৃত শেখ ইছামুদ্দিনের ছেলে। তিনি জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাই খন্দকার মোহতেশাম হোসেন ওরফে বাবরের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বিল্লাল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খন্দকার মোশাররফ সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর তিনি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ওই সময় মন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খন্দকার মোহতেশাম।

বিল্লাল হোসেন প্রথমে খন্দকার মোহতেশামের মুরগির খামারে চাকরি নেন। এ জন্য তিনি ‘মুরগি বিল্লাল’ নামেও পরিচিত। খন্দকার মোহতেশামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বিল্লাল বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে রাতারাতি ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। মোহতেশামের ‘আশীর্বাদেই’ তিনি জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ হন। একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকার মালিক তথা প্রকাশকও হন। সেই সুবাদে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সদস্য এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বিল্লাল।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরশেদ আলম বলেন, ডিবি পুলিশ শুক্রবার বিকেলে বিল্লালকে কোতোয়ালি থানায় সোপর্দ করেছে। শনিবার তাঁকে জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হবে।

প্রসঙ্গত, শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তাঁর ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাটি করে সিআইডি। গত ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় মামলাটি করেন সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ। এ মামলায় ওই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে উপার্জন ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়। এর আগে ১৬ মে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার মামলার আসামি হিসেবে ৭ জুন রাতে বরকত, রুবেলসহ মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শুক্রবারের দুজনকে নিয়ে এ পর্যন্ত মোট ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সিআইডির মামলায় দুই দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে বরকত ও রুবেলকে। এরপর ২৪ জুলাই তাঁরা ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

সিআইডির দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করছেন সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, যাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাঁদের সবার নাম জবানবন্দিতে প্রকাশ করেছেন রুবেল ও বরকত।

ফরিদপুরের সন্ত্রাসী দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত (৪৭) ও ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেলের দেওয়া জবানবন্দিতে নাজমুলের নাম একাধিকবার এসেছে। তাঁরা দুই ভাই সাবেক মন্ত্রী ও সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে দুই হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুই ভাই তাঁদের জবানবন্দিতে নাজমুল ও অন্যদের সঙ্গে মিলে তাঁরা কীভাবে ফরিদপুরে অপকর্ম করতেন, তার বিবরণ দিয়েছেন। পুলিশ ইতিমধ্যে বরকতদের একাধিক সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষককে গ্রেপ্তার করেছে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলেন ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরফে লেবি এ বিল্লাল।

জবানবন্দিতে বরকত বলেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। ২০১৫ সালের দিকে তিনি, তাঁর ভাই রুবেল, মোশাররফ হোসেনের এপিএস যুবলীগের নেতা এ এইচ এম ফুয়াদ, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার ওরফে লেবি এবং ফরিদপুর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান মিলে গোপন বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব কাজ তাঁরা ভাগাভাগি করে নেবেন। এর মধ্যে এলজিইডির টেন্ডারের দায়িত্ব আসে তাঁদের ভাগে। তিনি স্বীকার করেন, এলজিইডির সব উন্নয়নকাজে ১৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে তাঁরা কাজ পাইয়ে দেন। তাঁদের সম্মতি ছাড়া কেউ কাজ করতে পারতেন না।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বরকত আরও বলেন, ফরিদপুরের পাসপোর্ট অফিস, পৌরসভা, বিআরটিএ এবং ফুটপাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল হাসান খন্দকার লেবি। তাঁর পক্ষ নিয়ে চাঁদা তুলতেন শহর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম নাসিম।

গত ১৬ মে রাতে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে দুই দফা হামলার ঘটনা ঘটে। সুবল সাহার বাড়ি শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লাবাড়ি সড়কে। এ ঘটনায় গত ১৮ মে সুবল সাহা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। গত ৭ জুন রাতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার মামলার আসামি হিসেবে শহরের বদরপুরসহ বিভিন্ন মহল্লায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ সাজ্জাদ, ইমতিয়াজসহ মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে।