বানভাসি মানুষের কষ্টের দিনে ঈদ যেন বর্ণহীন

মোতালেব খানের বাড়িতে এ বছর ঈদের কোনো আয়োজন নেই। বাড়িতে যা রান্না হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তা–ই খেতে বসেছেন। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
মোতালেব খানের বাড়িতে এ বছর ঈদের কোনো আয়োজন নেই। বাড়িতে যা রান্না হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তা–ই খেতে বসেছেন। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

মোতালেব খানের চার ছেলে। দুজন ঢাকার একটি কারখানায় ও দুজন গ্রামে কাজ করেন। বন্যা ও করোনার কারণে চারজনেরই কাজ বন্ধ। প্রতিবছর তাঁরা কোরবানি দিতে পারলেও এ বছর ঈদে কোনো আয়োজন করতে পারেননি। ঈদের দিন সকালে (শনিবার) শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চরে মোতালেবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িতে মাছ রান্না হয়েছে। তাই দিয়ে ছেলে-নাতিকে নিয়ে খেতে বসেছেন তিনি।

ভারী কণ্ঠে মোতালেব খান বলেন, ‘ছেলেদের হাতে এখন সংসারের দায়িত্ব। প্রতিবছর ঈদে নানা আয়োজন থাকলেও এ বছর বন্যার কারণে কোনো আয়োজন করতে পারেনি। তা নিয়ে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। আল্লাহ নিশ্চয়ই এমনটা লিখে রেখেছিলেন। আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে দোয়া করছি, তিনি মানুষের এমন কষ্টের জীবন থেকে পরিত্রাণ দেবেন।’

শুধু মোতালেব নন, এমন চিত্র শরীয়তপুরের বানভাসি হাজারো মানুষের। অধিকাংশের বাড়িতে পানি, ঘরে পানি। অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, উঁচু স্থানে। ঘরে পানি থাকায় রান্নাবান্না করতেও সমস্যা হচ্ছে। অন্তত এক মাস যাবৎ বন্যায় গ্রাম তলিয়ে থাকায় কোনো কাজ নেই। আয়হীন অবস্থায় থেকে শ্রমজীবী মানুষ পড়েছেন চরম বিপাকে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ঈদের আয়োজন করতে পারেননি অনেকে। তাঁদের কষ্টের জীবনের মধ্যে ঈদ এসেছে বর্ণহীন হয়ে।

শুকুরজান বেগমের উঠানে পানি। ঘরে স্বামী বেকার। হাতে টাকা না থাকায় ঈদের কোনো আয়োজন নেই। আজ শনিবার জাজিরার বিলাশপুরে। ছবি: প্রথম আলো
শুকুরজান বেগমের উঠানে পানি। ঘরে স্বামী বেকার। হাতে টাকা না থাকায় ঈদের কোনো আয়োজন নেই। আজ শনিবার জাজিরার বিলাশপুরে। ছবি: প্রথম আলো

নড়িয়ার মুলপারা গ্রামে বসবাস শাহানারা বেগমের (৬৫)। স্বামী করম আলী মৃধা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। দুই ছেলে শ্রমিক। তাঁদের আয়ে সংসার চলে। করোনা আর বন্যায় দীর্ঘ চার মাস যাবৎ তাঁদের আয় নেই। কষ্টের জীবন পার করছে নয় সদস্যের পরিবারটি। প্রতিদিন সকালে অসুস্থ স্বামীর জন্য রান্না করতে হয় শাহানারাকে। শাকসবজি আর ডালেই চলে তাঁদের খাওয়া। ঈদের সকালেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বাড়তি কেবল যুক্ত হয়েছে বড় মেয়ের পাঠানো মাছ। আত্মীয়রা কোরবানির মাংস দিলে তা রান্না করবেন, এমন প্রস্তুতি রেখেছেন।

শাহানারা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, এমন কষ্টের জীবন কখনো পার করেননি তিনি। উঠানে পানি, সারা গ্রামে পানি, কোথাও যেতে পারেন না। স্বামী যখন সুস্থ ছিলেন, সন্তানদের কাজ ছিল, তখন ভাগে কোরবানি দিতেন। কথা বলতে বলে চোখে পানি আসে তাঁর। পানি মুছতে মুছতে শাহানারা বলেন, ‘এখন আত্মীয়রা কোরবানির মাংস দিলে তা তবারক ভেবে খাব আর দেশবাসীর জন্য দোয়া করব। আল্লাহ যেন দ্রুত এ মহামারি থেকে আমাদের মুক্তি দেন।’

নড়িয়ার মৃধাকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, এক শিশু নৌকা চালিয়ে বাড়িতে ফিরছে। নৌকায় বাজারের ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন এক নারী। নৌকা নিয়ে কাছে যেতেই কষ্টের জীবনের কথা জানালেন নৌকায় বসে থাকা ওই গ্রামের বাসিন্দা হনুফা আক্তার। তাঁর স্বামী আবুল হোসেন ঢাকার ফুটপাতে ফল বিক্রি করেন। আর চার সন্তান নিয়ে তিনি গ্রামে থাকেন। করোনার কারণে চার মাস স্বামী কোনো কাজ করেননি। এখন কাজ শুরু হলেও বিক্রি ভালো না থাকায় আয় নেই। স্বামীও বাড়িতে আসেননি, এ বছর বাড়িতে কোরবানির কোনো আয়োজন করতে পারেননি। সন্তানেরা ঈদের দিন মাংস খাবে, এমন বায়নায় বিপাকে পড়েন হনুফা। এক আত্মীয়র কাছ থেকে টাকা ধার করে বাজার থেকে মাংস কিনে নৌকায় শিশুছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

শাহানারা বেগমের বাড়িতে ঈদের কোনো আয়োজন নেই। প্রতিদিনের মতো শাকসবজি রান্নায় ব্যস্ত তিনি। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মুলপারা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
শাহানারা বেগমের বাড়িতে ঈদের কোনো আয়োজন নেই। প্রতিদিনের মতো শাকসবজি রান্নায় ব্যস্ত তিনি। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মুলপারা গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

নৌকায় যেতে যেতে হনুফা আক্তার বলেন, ‘এমন কষ্টের জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়া যে কত বেদনার, তা বোঝাতে পারব না। অবুঝ শিশুরা যখন বায়না করে, মা হিসেবে তা এনে দেওয়ার জন্য মন কাঁদে। কিন্তু সামর্থ্য তো নেই। করোনা আর বন্যা আমাদের জীবন বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। কষ্টের মধ্য দিয়েই ঈদের আনন্দটি চলে যাবে।’

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, জুলাই মাসের শুরুর দিকে শরীয়তপুরের বিভিন্ন স্থানে বন্যার পানি ঢুকতে থাকে। এখন জেলার নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার ৪০০ গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্ধী হয়ে পড়েছেন সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সাড়ে ছয় শ মেট্রিক টন চাল ও চার হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দিয়েছে। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন ওই চাল ও খাবারের প্যাকেট ৬৪ হাজার পরিবারের মধ্যে বিতরণ করেছে।

জাজিরার বিলাশপুরের বাসিন্দা শুকুরজান বেগমের স্বামী গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাপড় বিক্রি করেন। করোনার কারণে টানা চার মাস কাজ বন্ধ ছিল। এরপর এক মাস যাবৎ বন্যার পানিতে বন্ধী। আয়হীন অবস্থায় পরিবারটি অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। শুকুরজান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তবে কখনো এমন খাওয়ার কষ্ট করতে হয়নি। ঘরে পানি, গ্রামে পানি। কোথায়ও যেতে পারছেন না, কীভাবে ঈদের বাড়তি আয়োজন করবেন। সন্তানেরা মাংস খাওয়ার বায়না করছে, কিন্তু আজও শাকপাতা রান্না করতে হবে।

বন্যার পানিতে গ্রাম প্লাবিত। নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। ঈদের নামাজ পড়তে নৌকা নিয়ে বের হয়েছেন একদল মানুষ। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বন্যার পানিতে গ্রাম প্লাবিত। নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। ঈদের নামাজ পড়তে নৌকা নিয়ে বের হয়েছেন একদল মানুষ। আজ শনিবার সকালে নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

মুলাপারা মৃধাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা পারভেজ কোটোয়ারি গাজীপুরের একটি স্টুডিওতে কাজ করতেন। করোনার প্রভাব শুরু হলে গ্রামে চলে আসেন। আর কর্মস্থলে ফেরা হয়নি। চার মাস বেকার ছিলেন। বন্যায় গ্রাম তলিয়ে গেলে নৌকা চালিয়ে যাত্রী পারাপার করেন। ঈদের দিনেও নৌকা নিয়ে এসেছেন যাত্রী পারাপার করতে। পারভেজ বলেন, ‘আমাদের মতো গরিব মানুষের এই মুহূর্তে দুবেলা খেয়ে বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। তাই ঈদের কোনো আয়োজন নেই পরিবারে। এভাবেই কষ্টের জীবনের সাক্ষী হয়ে বর্ণহীন ঈদ চলে যাবে আমরা বুঝতেও পারব না।’

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রভাব মানুষের জীবন থেকে এখনো কাটেনি। তার মধ্যেই বন্যা মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট চরমভাবে বাড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার চেষ্টা করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে থাকতে। জেলা প্রশাসন মানুষের কষ্ট ঘোচাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারি সহায়তার বিভিন্ন কর্মসূচির বাইরে জেলা প্রশাসনের মানবিক সহায়তা একটি তহবিল রয়েছে, সেখান থেকেও অসহায় মানুষদের সহায়তা করা হচ্ছে।