করোনায় মলিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রবাসী পরিবারের ঈদ

‘প্রতিবছর ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকায় গরু কিনে একা কোরবানি দিতাম। এ বছর তিনজন মিলে ৫১ হাজার টাকায় কোরবানির জন্য একটি গরু কিনেছি। গত ফেব্রুয়ারিতে ছুটিতে দেশে এসে বিয়ে করি। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সংসারের খরচ চালাতে স্ত্রীর জন্য কেনা ছয় ভরি স্বর্ণালংকার বিক্রি করে দিয়েছি। এ দিয়েই সংসার চলছে।’ গতকাল শুক্রবার বিকেলে কথাগুলো বলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিজয়নগর উপজেলার আইড়ল গ্রামের বাসিন্দা সৌদিপ্রবাসী মো. রিমন মিয়া।

এমন অবস্থা শুধু রিমনের একার নয়; ছুটিতে এসে করোনাভাইরাসের কারণে আটকে পড়া জেলার প্রবাসীদের জীবনের চিত্র এখন এমনই।

ছুটিতে আসা প্রবাসীরা পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। জমানো টাকা আর ঋণ করে চলছে তাঁদের সংসার। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক প্রবাসীর ভিসা ও ইকামার মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। দ্রুত কর্মস্থলে ফিরতে না পারলে তাদের প্রবাসে যাওয়া অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। বাংলাদেশের যে কয়টি জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি বাইরে কাজ করতে যান, তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম।

মা-বাবা, স্ত্রী, তিন বোন ও দুই ভাই নিয়ে রিমনের পরিবার। রিমনই পরিবারের খরচ চালান। বোন বিউটি আক্তারের বিয়ে হয়েছে। বাকি দুজনের মধ্যে মৌসুমী আক্তার দ্বাদশ শ্রেণিতে এবং ডলি একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ভাই মো. সাইদ নবম শ্রেণির ছাত্র। রিমন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যেক রোজার ঈদে সবার জন্য বিশেষভাবে কেনাকাটা করতাম। কিন্তু এ ছর সাদামাটা ঈদ কেটেছে। বুঝতেই পারছেন পরিস্থিতি কতটুকু খারাপ।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘দেশে এসেই ফেঁসে গেলাম। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ৫০ দিনের ছুটিতে সৌদি আরব থেকে দেশে আসি। ২ এপ্রিল ছুটির মেয়াদ শেষ হয়। ভিসা ও ইকামার মেয়াদও শেষ হয় এপ্রিল মাসে। দুই দফায় ভিসা-ইকমার মেয়াদ আগামী ২০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যেতে না পারলে হয়তো আর যেতে পারব না। সৌদি সরকার দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েছে। মনে হয় না আর বাড়াবে। করোনার কারণে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর গয়নাও বিক্রি করতে হয়েছে।’

একই উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের ভিটি দাউদপুর গ্রামের সৌদিপ্রবাসী ফারুক মিয়া গত ৫ জানুয়ারি পাঁচ মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। জুন মাসে তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। আসার সময় যাওয়ার টিকেটও কেটে রেখেছিলেন। ফারুক মিয়া বলেন, ‘১৭ বছর ধরে প্রবাসে ছিলাম। সব সময় কোরবানি দিয়েছি। এবার অবস্থা ভালো নেই। তাই কোরবানি দিইনি। গত বছরও ২০ হাজার টাকায় শরিক হয়ে অন্যদের সঙ্গে মিলে পশু কোরবানি দিয়েছি। স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে এখন দিন কাটাতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। সৌদি আরবে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। মাসে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা বেতন পেতাম। দেশে পাঁচ মাস ধরে বসা। আগের জমানো টাকা দিয়ে চলছি। টাকাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে যেতে পারছি না। এখন সৌদি সরকার কী করে, সেটির দিকে তাকিয়ে আছি।’

একই গ্রামের ফরিদ মিয়া গত মার্চ মাসের প্রথম দিকে তিন মাসের ছুটিতে দেশে আসেন। ১৪ বছর ধরে তিনি সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে বাংলাদেশি টাকায় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা মাসে রোজগার হয়। দেশে প্রতি মাসে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পাঠাতাম। করোনার কারণে প্রায় পাঁচ মাস ধরে জমানো টাকায় সংসার চলছে। টাকাও প্রায় শেষ।’ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এলাকায় কাজ খোঁজার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মানুষ কাজ দেয় না। বলেন যে বিদেশ থেকে এসেছ, কী কাজ করবা?’

ভিটি দাউদপুর গ্রামের কাতারপ্রবাসী মো. উসমান মিয়া (৪০) গত ১০ মার্চ সাত দিনের ছুটিতে দেশে আসেন। ১৭ মার্চ ফেরার কথা ছিল। কিন্তু করোনায় তাঁর ফিরে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাতারে আমি ট্যাক্সি চালাতাম। কিন্তু দেশে এসে আমি বেকার। পাঁচ মাস ধরে কোনো আয়–রোজগার নেই। গরু কেনার টাকা কোথায় পাব? ঘরের ছোট গাভিটা কোরবানি দেব।’ তিনি বলেন, বাবা-মা, স্ত্রী, দুই সন্তান মো. ফাহিম (৬) ও মো. রাহিমকে (৩) নিয়ে পরিবারের সদস্য আটজন। সৌদি আরবে থাকা ছোট ভাই আব্দুর রহমানের (২৭) পাঠানো টাকায় সংসার চলছে। করোনা সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত ১২ হাজার ৭৬৯ জন প্রবাসী জেলায় আসেন। তাঁদের মধ্যে মার্চ মাসে ১০ হাজার ২২৪ জন, এপ্রিলে ১৬৯ জন, মে মাসে ৩৪৩ জন, জুনে ৭৭৫ জন ও জুলাই মাসে ১ হাজার ২৫৮ জন দেশে ফিরে আসেন।

নাসিরনগর উপজেলার নাসিরপুর গ্রামের দুবাইপ্রবাসী সৈয়দ শামীম আহমেদ ৪ মার্চ তিন মাসের ছুটি দেশে আসেন। ৩ জুন তাঁর ফেরার কথা ছিল। তাঁর ছোট দুই ভাই সৈয়দ রাকিব (২৯) ও সৈয়দ তারিফ (২৫) কাতারপ্রবাসী। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছর একাই কোরবানি দিতাম। এবার শরিক হয়ে পাঁচজন মিলে গরু কিনেছি।’

বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদের কুয়েতপ্রবাসী সুমন মিয়া গত ১২ জানুয়ারি তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। ১২ এপ্রিল ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও কারোনায় সেটি আটকে যায়। তিনি বলেন, ‘আগে হাসিখুশি, টাকাপয়সা, খানাদানা, কেনাকাটা সবই ছিল। এখন করোনার কারণে কোনো কিছু খেতে ইচ্ছে করলেও খাই না। কারণ, টাকা নেই। অক্টোবর পর্যন্ত ইকামার মেয়াদ আছে। ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আর যেতে পারব না। কুয়েতে তিন মাস কাজ করলে এক মাসের বেতন পেতাম। তাতেই মোটামুটি পরিবারের খরচ চলত।’