কোরবানি দূরের কথা সেমাই-চিনিও কিনতে পারেননি

ঈদের খুশি নেই পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে। শুক্রবার খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস শ্রমিক কলোনি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
ঈদের খুশি নেই পাটকল শ্রমিকদের মধ্যে। শুক্রবার খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস শ্রমিক কলোনি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

মো. শুক্কুর আলী কাজ করতেন খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের মোটা তাঁত বিভাগে। গত বছর কোরবানি ঈদের অন্যের সঙ্গে মিলে গরু কোরবানি দিয়েছিলেন। কিনেছিলেন তিন ছেলে-মেয়ের জন্য সামান্য কিছু পোশাকও। কিন্তু এবার সবই উল্টে গেছে। গরু কোরবানি তো দূরে কথা ঈদের আগের দিন বিকেল পর্যন্ত সেমাই-চিনিও কিনতে পারেননি।

প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক কলোনির উত্তর কাটা লাইনের একটি ঘরে পরিবার নিয়ে বাস করেন শুক্কুর আলী। ঈদের আগের দিন শুক্রবার বিকেলে ঘরের সামনেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী মিল বন্ধ করে দেওয়ার আগে শ্রমিকদের দুই মাসের মজুরি অগ্রিম দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেওয়া হয়েছে মাত্র এক মাসের, তাও ছয় দিনের মজুরি কেটে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো পেয়েছি। ওই টাকা দিয়ে ধার-দেনা শোধ করে যা ছিল তা সংসার খরচেই চলে গেছে। এখন বাকিটা সময় কীভাবে চলবে সেই চিন্তাই আছি। কাছে টাকা না থাকায় ঈদের চিন্তাই মাথায় আনতে পারছি না।’

শুক্কুর আলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সেখানে জড়ো হন প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ। প্রায় সবার অবস্থা একই রকম। গতবার যারা কোরবানি করেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই এবার তা দিতে পারছেন না। অধিকাংশ ঘরেই হয়নি বিশেষ কোনো বাজার। অন্যদিকে কলোনিতে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে শুরু হয়েছে ঘর ছাড়ার আতঙ্ক। একে তো টাকা নেই অন্যদিকে ঘর ছেড়ে দিতে হলে কোথায় গিয়ে থাকবেন তা নিয়ে দিশেহারা শ্রমিকেরা।

আক্কাস আলী নামের আরেক শ্রমিক বলেন, বলা হয় ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু কোনো শ্রমিকের ঘরেই ঈদ আনন্দ নেই। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করত। অন্যটি পড়াশোনা করেন। করোনার কারণে বড় ছেলের ওই কাজ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। গত তিন মাস ছেলে বাড়িতে এসে বসে আছে। এখন সবাইকে নিয়ে কোনো রকম দিন পার করছেন। ঈদ কী জিনিস তা ভুলে গেছেন।

অর্থের অভাবে ঈদে ছেলেমেয়েদের কিছুই দিতে পারেননি তাসলিমা বেগম। শুক্রবার খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস শ্রমিক কলোনি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
অর্থের অভাবে ঈদে ছেলেমেয়েদের কিছুই দিতে পারেননি তাসলিমা বেগম। শুক্রবার খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস শ্রমিক কলোনি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

বছরে ১৮০ দিন কাজে হাজির থাকলে ঈদ বোনাস পেতেন পাটকল শ্রমিকেরা। গত ১ জুলাই মিল বন্ধ করার নোটিশ দেওয়ার আগে অধিকাংশ শ্রমিকেরই হাজিরা ওই সময়ের বেশি হয়ে গেছে। এ হিসেবে তাঁরা বোনাস পাবেন বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু বোনাস না দেওয়ায় আরও বেশি হতাশ শ্রমিকেরা। অন্যদিকে গত বছরের ৬ সপ্তাহের বকেয়া মজুরি না পাওয়ার আক্ষেপও রয়েছে তাঁদের মধ্যে।

শুক্কুর আলীর কয়েক ঘর আগেই তাসলিমা বেগমের ঘর। তাঁর স্বামী মজিবর রহমান ওই জুট মিলের ড্রয়িং বিভাগের শ্রমিক ছিলেন। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে খুলনার একটি কলেজে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী, মেজ ছেলে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে আর মেয়েটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে। ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাসলিমা। তিনি বলেন, ঈদ উপলক্ষে ছেলে-মেয়েদের জন্য এমনকি খাওয়ার জন্য বিশেষ কিছুই কেনা হয়নি। স্বামী অসুস্থ। যে টাকা পেয়েছিলেন তা স্বামীর চিকিৎসা আর ওষুধ কিনতেই খরচ হয়ে গেছে। মিল বন্ধ করার নোটিশ দেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি যে আতঙ্ক ভর করছে তা হলো ঘর ছাড়ার আতঙ্ক। কাছে টাকা নেই অন্যদিকে ঘর ছেড়ে দিলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় থাকবেন?

ওই কলোনির ভেতরের সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে আসার সময় কথা হয় মিজানুর রহমান নামের আরেক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, কলোনিতে সাড়ে ৮০০ মতো পরিবার বাস করে। অন্য সময় ৫০টির বেশি গরু কোরবানি দিতেন শ্রমিকেরা। কিন্তু এবার হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র কোরবানি দিচ্ছেন। ঈদের আগে শ্রমিক কলোনিগুলো গমগম করত। কিন্তু এখন তার কিছুই নেই। যাদের অন্য জায়গায় বাড়ি আছে এমন কিছু পরিবার কলোনি ছেড়ে চলে গেছেন, বর্তমানে কলোনিতে যারা রয়েছেন তাঁদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

প্লাটিনাম জুট মিলের কিছুটা দূরেই ক্রিসেন্ট জুট মিল। শ্রমিক কলোনি ওই মিলের সীমানার মধ্যেই। সেখানে গিয়ে কথা হয় মো. আলমগীর নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জুলাই মাসের বেতন বাবদ ১১ হাজার টাকা পেয়েছি। ওই টাকার বেশির ভাগই ধার-দেনা শোধ করতেই চলে গেছে। চার ছেলে-মেয়ের সংসারে ঈদের জন্য কাউকেই কিছু কিনে দিতে পারেনি। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁদের লেখাপড়াও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।’ মজিবুর রহমান নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘যদি বোনাসটাও পাওয়া যেত তাহলে সংসার চালাতে শ্রমিকদের এতটা ভুগতে হতো না।’