বগুড়ার বেনারসিপল্লির তাঁতিদের মুখ মলিন

বেনারসি শাড়ি তৈরি করছেন তাঁতশিল্পী আকতার হোসেন। সম্প্রতি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী বিহারি কলোনি এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা
বেনারসি শাড়ি তৈরি করছেন তাঁতশিল্পী আকতার হোসেন। সম্প্রতি বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ী বিহারি কলোনি এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা

করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে দোকানপাট, বিপণিবিতান বন্ধ। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আসছে না শাড়ির ফরমাশ। আসছে না বেনারসি-কাতান-জামদানি তৈরির কাঁচামালও। এ কারণে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বেনারসিপল্লির অধিকাংশ তাঁত এখন বন্ধ। বেকার তাঁতিরাও। অন্যবার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে তাঁতের খটখট শব্দে সরগরম হয়ে উঠত বেনারসিপল্লি। এবার তাঁতযন্ত্রের সেই মুখর শব্দ নেই। তাঁত বন্ধ থাকায় মুখ মলিন তাঁতিদের।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে শেরপুর উপজেলার ঘোলাগাড়ি অবাঙালি কলোনির বেনারসিপল্লিতে দেখা যায়, অধিকাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে। কোনো রকমে দু-একটি তাঁতে সচল রয়েছে। তাঁতিরা বলছেন, এখানকার কাতান, জামদানি, বেনারসি শাড়ি যায় রাজধানীর মিরপুরের বেনারসিপল্লির পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে। আগে থেকেই তাঁরা অর্ডার দিয়ে শাড়ির সরবরাহ নেন। কিন্তু করোনার কারণে চার মাস ধরে অর্ডার আসছে না। বেনারসি তৈরির কাঁচামাল রেশম সুতার সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। শাড়ি বাজারজাতে ভোগান্তির কারণে এই শিল্পে চরম দুর্দিন নেমে এসেছে।

আশির দশকে ঘোলাগাড়ি কলোনির একজন অবাঙালি মিরপুরের বেনারসিপল্লি থেকে কাতান-বেনারসি-জামদানি শাড়ি বানানো শিখে এসে নিজেই তাঁত বসিয়ে শাড়ি বানানো শুরু করেছিলেন। তারই সূত্র ধরে গড়ে উঠেছিল ঘোলাগাড়ি বেনারসিপল্লি। পরে স্থানীয় প্রায় ২০০ ঘর বাঙালিও বেনারসি তৈরি শিখে জড়িয়ে পড়েন এই শিল্পে। ক্রমে কারিগরেরা এই শিল্পকে আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে দেন। তবে নানা সংকটে তাঁতি ও তাঁতযন্ত্রের সংখ্যা কমেই চলেছে। কয়েক বছর আগেও যেখানে ৫০ জন তাঁতি আর ১০০ তাঁতযন্ত্র ছিল, সেখানে এখন টিকে আছে মাত্র ২০ জন তাঁতি ও ৫০টির মতো তাঁতযন্ত্র।

ঘোলাগাড়ি গ্রামে এখন ওয়াহেদ হোসেনের পাঁচটি তাঁতযন্ত্র, সেলিম হোসেন ও নাছিম হোসেনের তিনটি তাঁতযন্ত্র, খুরশীদ হোসেনের পাঁচটি তাঁতযন্ত্র, আবদুল মজিদের তিনটি তাঁতযন্ত্র, আজাদ হোসেনের দুটি তাঁতযন্ত্রসহ অন্যদের একটি করে তাঁতযন্ত্র টিকে আছে। অনিয়মিত চালু রয়েছে শামিম আকতার, রেজাউল করিম, আবদুর রশীদ, কামরুল, শাহিদ ও জাহিদের তাঁতযন্ত্র।

ওয়াহেদ হোসেনের হাত ধরেই গ্রামে প্রথম তাঁত এসেছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় তাঁর একারই ৮টি তাঁত ছিল। এখন তা কমে গিয়ে পাঁচটিতে নেমেছে। তিনি জানান, তাঁত পুরোদমে চালু থাকলে মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন হতো তাঁর। করোনার কারণে চার মাস ধরে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্ডার আসা বন্ধ। তাঁতে উৎপাদনও প্রায় বন্ধ। ৩৫ হাজার টাকার একটি শাড়ি বুনছেন দুই মাস ধরে। নতুন শাড়ি উৎপাদন নেই, বিক্রি নেই, আয়-উপার্জনও নেই। সংসার প্রায় অচল। সরকারি কোনো সহযোগিতা নেই, নেই তাঁতিদের জন্য কোনো প্রণোদনা।

আবদুল ওয়াহেদ বলেন, ‘অন্য বার তো ঈদের বাজার ধরতে বেনারসিপল্লি সরগরম হয়্যা উঠিচ্চিল। এবার করোনার জন্যি ঈদুল ফিতর থ্যাকেই শাড়ি বেচাবিক্রি বন্ধ। করোনাত দ্যাশের লোক মরিচ্চে, কেউ মার্কেটত যাচ্চে না। শাড়িও লিচ্চেনা কেউ।’

কয়েকজন তাঁতি প্রথম আলোকে জানান, এখানকার প্রতিটি শাড়ি প্রকারভেদে ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। একটি শাড়ি বুনতে তিন দিন থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। একটি শাড়িতে গড়ে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি রেশম সুতা লাগে। এক কেজি সুতার দাম ১ হাজার টাকা। প্রতিটি শাড়িতে তাঁতিদের গড়ে দুই-তিন হাজার টাকার মতো লাভ থাকে। তাঁতিরা বলছেন, বেনারসি তৈরির সুতার দাম দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে তাঁতশ্রমিকের পারিশ্রমিকও। সেই তুলনায় শাড়ির দাম তেমন একটা বাড়ছে না। এতে করে তাঁতিরা তাঁত বন্ধ করে দিয়ে পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এই পল্লির আরেক তাঁতি খুরশীদ হোসেনের ১০টি তাঁতযন্ত্রের মধ্যে বর্তমানে ৫টি চালু রয়েছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে শাড়ির চাহিদা না থাকা এবং ঢাকা থেকে রেশম সুতা সংগ্রহ করতে না পারায় চার মাস ধরে বেনারসি পল্লি সংকটে ধুঁকছে।

তাঁতিরা জানান, এমনিতেই নতুন করে কেউ আর এই পেশায় আসছে না। তার ওপর আবার করোনার সংকটে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে। বেনারসিপল্লির তাঁতশিল্পকে বাঁচাতে সরকারিভাবে তাঁতিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে এখানকার সব তাঁত বন্ধ হয়ে যাবে, তাঁতিরা পেশা পাল্টাবে। বেনারসিপল্লির এ শিল্প ঐতিহ্য হারাবে।