স্বজনদের ছেড়ে কর্মস্থলে ঈদ, তবু আক্ষেপ নেই

করোনাকালে ভিন্ন আঙ্গিকে ঈদ জামাতের নিরাপত্তার কাজ করছেন পুলিশের সদস্যরা। শনিবার সকালে সিলেট দরগাহ মসজিদের সামনে। ছবি: প্রথম আলো
করোনাকালে ভিন্ন আঙ্গিকে ঈদ জামাতের নিরাপত্তার কাজ করছেন পুলিশের সদস্যরা। শনিবার সকালে সিলেট দরগাহ মসজিদের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

সকাল তখন আটটা। সিলেট নগরের দরগাহ গেট এলাকা। ঈদের জামাতে অংশ নিতে সারি ধরে মসজিদের দিকে এগোচ্ছিলেন মুসল্লিরা। তাঁদের হাতে জীবাণুনাশক দিতে ব্যস্ত পুলিশ সদস্য সফি আহমেদসহ কয়েকজন। মুসল্লিদের মসজিদে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, মাস্ক পরার সচেতন করার পাশাপাশি তাপমাত্রা মেপে প্রবেশ করানোর কাজ করছিলেন পুলিশের এই সদস্যরা।

গত মার্চ থেকে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এরপর থেকে সফির মতো অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারেননি। কারণ, ঈদে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ না করার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। তাই রোজার ঈদের মতো কোরবানির ঈদও পরিবার থেকে দূরেই কাটিয়েছেন তাঁরা।

সফি আহমেদ সিলেট নগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখায় কর্মরত। বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। ২০১৪ সালে চাকরিতে যোগদানের পর থেকে এই প্রথম কোরবানির ঈদ কাটাচ্ছেন কর্মস্থলে। তার পরও মনে কোনো আক্ষেপ নেই বলে জানালেন সফি। তবে দুদিন থেকে বৃদ্ধা মায়ের ফোন পেয়ে মনটা কিছুটা খারাপ তাঁর। মা বলেছিলেন, এবার কিছু সময়ের জন্য হলেও বাড়িতে যেতে। তবে সেটি সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন সফি।

ঈদের জামাতে মুসল্লিদের নিরাপত্তা কাজ শেষে নিজেরাও নামাজ পড়ে দুপুরে কর্মস্থলে ফিরে দায়িত্ব শেষ করেছেন সফি। পরে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা হয়েছে তাঁর। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। সে জন্য আর বেশি কথা হয়নি। মাকে বলেছেন, কর্মস্থলে ভালোই ঈদ কাটছে।

এবার ভিন্ন আমেজে ঈদ কাটাচ্ছেন জানিয়ে সফি বলেন, ‘আমরা নিজেরাও ঈদের নামাজ পড়েছি। শেষে অফিসে গিয়ে আরও কিছু কাজ শেষ করেছি। পরে সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে নিজ কক্ষে গিয়ে মুঠোফোনে পরিচিতজনের ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। তবে বাড়িতে থাকলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মেতে উঠতাম। পরে অনেকের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে দিন কেটে যেত। এগুলো এবার মিস করছি।’

পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট সফি। সে জন্য সবাই তাঁকে আলাদাভাবে স্নেহ করেন। প্রতি ঈদে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় করে কাটে সফির। এবার কর্মস্থলেই ঈদ করতে হচ্ছে তাঁর। তাঁর মতো অন্য সহকর্মীরা কর্মস্থলে ঈদ কাটালেও অনেকে রোজার ঈদ বাড়িতে কাটিয়েছেন। সফি রোজার ঈদে ছুটি না নিয়ে কোরবানির ঈদে ছুটি নিতে চেয়েছিলেন। তবে করোনার কারণে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মস্থলেই ঈদ কাটাতে হচ্ছে তাঁর।

আরও একটি মানবিক কাজও করছেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলীর ছেলে সফি। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা করে যাচ্ছেন তিনি। গত ২৬ মার্চ কয়েকজন সহকর্মী মিলে মাসিক রেশন বরাদ্দ রেখে দেন অসহায় মানুষকে সহায়তার জন্য। যে কেউ মুঠোফোনে সহায়তা চাইলে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে দিতেন খাদ্যসহায়তা। এ জন্য পুলিশে কর্মরত একাধিক সদস্যের রেশন কিনে নিতেন তাঁরা। প্রথম দিকে কাজটা করতেন মানবিক সহায়তার টানে। এখন তা ছাপিয়ে নেশায় পরিণত হয়েছে সফি আহমদের।

প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ে নিজের দায়িত্ব পালন শেষে বেড়িয়ে পড়েন চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্যাকেট নিয়ে। এতেই যেন অদৃশ্য কারণে শান্তি মেলে তাঁর। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার পরিবারকে সহায়তা করেছেন। সফি আহমেদ বলেন, প্রবাসী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত অসহায় মানুষকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। অসহায় ব্যক্তিদের জন্য সারা জীবন এমন ফেরিওয়ালা হয়ে থাকতে চান তিনি।