মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি পাওয়া শিপনের শুধু অভাব আর অভাব

শিপন এখন জমি বর্গা নিয়ে আমন ধান চাষ করছেন। ছবি সংগৃহীত
শিপন এখন জমি বর্গা নিয়ে আমন ধান চাষ করছেন। ছবি সংগৃহীত

শিপন রায়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এম এ প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হয়েছেন। এমফিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। টিউশনি করতেন। করোনাভাইরাসের বিস্তারে এমফিলের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়নি। যে দুইটি টিউশনি করতেন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।

জীবন তো আর থেমে যায়নি। ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন পে ইট ফরওয়ার্ড, বাংলাদেশের বৃত্তি পাওয়া একজন শিক্ষার্থী শিপন। বিপদের সময় ওই সংগঠনের কাছ থেকেই আবার ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তাই দিয়ে ফেনীর চরচান্দিয়া গ্রামে ৭০ শতক জায়গায় নিজেই আমনের বর্গাচাষ করছেন শিপন। জমির মালিক কোনো খরচ দিচ্ছেন না, তাই ৪৫ শতকের জমির ধান পাবেন শিপন।

শিপনের মা গীরু বালা রায়ও বলতে গেলে সারা জীবনই মানুষের জমিতে ও বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের বড় করেছেন। এখন অসুস্থ থাকায় আর কাজ করতে পারেন না। শিপনের এক ভাই নাপিতের কাজ করেন। আরেক ভাই রিকশা চালান। দুই ভাইই আলাদা সংসার পেতেছেন। দুই ভাই ও শিপন মিলে মায়ের খরচ দেন। নিজেদের বলতে গেলে কোনো জায়গাজমি নেই।

শিপনের বাবা স্বপ্ন রায় মানুষের জমিতে দিন মজুরি করতেন তিনি মারা গেছেন বহু বছর আগে। শিপনের এক বোনের বিয়ে হয়েছে। আরেক বোন তিন বছর ও ১৫ মাস বয়সী দুই সন্তান রেখে মারা গেলে শিপনকে দীর্ঘদিন এই দুই ভাগনে-ভাগনির খরচও দিতে হয়েছে। এখন ওরা তাদের বাবার কাছে থাকে। এখন ভাগনে পড়াশোনার পাশাপাশি কাঁকড়া ধরে তা বিক্রি করে তার বোনের পড়ার খরচ দিচ্ছে।

শিপন মানুষের জমিতে কাজ করেছেন। মানুষের বাড়ির টয়লেটও পরিষ্কার করেছেন। করেছেন নাপিতের কাজ। টাকার অভাবে এক সময় পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যায়। শিপন বললেন, ‘কিছু মূলধন সহায়তা পেয়েছি, তাই বেঁচে থাকার জন্য বা টিকে থাকার জন্য নতুন যুদ্ধ শুরু করি। এখন আমি বর্গাচাষ করি। এতে আমার কোনো লজ্জা নেই। আমি আমার জীবনের গল্পগুলো ফেসবুকেও লিখে রাখি।’
শিপনের যুদ্ধটা শুরু হয়েছে সেই ছোট বেলা থেকেই। শিপন বললেন, ‘আমার বয়স তখন নয় বা ১০ বছর। ঘরে কোনো খাবার নেই। রিকশা চালক ও আমাদের থেকে আলাদা থাকা বড় ভাই শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন। ভাইয়ের রিকশার তালা ভেঙে রিকশা নিয়ে বাজারে যাই। সারা দিনে ৮৫ টাকা রোজগার, মাকে চাল ডাল কিনে দিলাম। মা যে কি খুশি হয়েছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা নাপিতের কাজ করেছি। অনার্সে তৃতীয় বর্ষে গিয়ে নাপিতের কাজ বাদ দিলাম। পরে শুরু করি টিউশনি। করোনায় টিউশনি চলে গেছে। পরিবারকে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়ে এখন আমি গ্রামে বর্গাচাষ করছি।’

শিপন বললেন,‘নাপিতের কাজ শুরুর আগে প্রশিক্ষণ নিই। প্রায় তিন মাসের মাথায় আয় করা শুরু করি। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তিন বছর পর আবার গ্রামের একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হলাম। সেলুনে কাজ করার সময় শিক্ষকদের চুল, দাঁড়ি কেটেছি। এ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ক্লাসে ঢুকতে দেরি হতো।’
শিপন জানালেন, এই জীবনে এক বার মাত্র এক মাস প্রাইভেট পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপরও এসএসসি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ফলাফল বেশ ভালোই হয়। কলেজে পড়ার সময় বিনা চিকিৎসায় বাবা মারা যান। বড় বোন মারা যান। এ সবের মধ্যে এইচএসসিতেও প্রথম শ্রেণি পান । ভর্তি কোচিং না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স পান। ফলাফলের দিক থেকে অনার্সে প্রথম শ্রেণি এবং এম এ তে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এম এ পরীক্ষার পর চট্টগ্রামে এক বস্তিতে থেকেছেন।

শিপন মাঠে কাজ করছিলেন, মুঠোফোনে কথা হয়। শিপন জানালেন, কাঁকড়া, আলু-এসব খাবার খেয়েই শিপন আর তাঁর মায়ের দিন কাটছে। শিপন বললেন,‘
চিংড়ি মাছের মতো রান্না করলে কাঁকড়া খেতে খুব মজা। কিন্তু অভাবের জন্য মা তো রান্নার সময় তেল, মসলা বেশি দিতে পারেন না। আলু দিয়ে রান্না করেন। তাই মা ও ছেলে খাই।’

আর্থিকভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলেও শারীরিক পরিশ্রম করে মানুষের পাশে থাকতে চেষ্টা করেন শিপন। ঈদের জামাতে নামাজ পড়তে আসা মানুষের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্ন না হয় সে জন্য অন্যদের সঙ্গে নিজেও এর আগে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে লাশ দাহ বা দাফন করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সরকারিভাবে লাশ সৎকারের সুযোগ না পেলেও গ্রামের কেউ মারা গেলে শিপন এগিয়ে যান।

মায়ের সঙ্গে শিপন। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের সঙ্গে শিপন। ছবি: সংগৃহীত

শিপন নিজ উদ্যোগেই গড়ে তুলেছেন প্যারেন্টস কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি সংগঠন। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চুল, দাঁড়ি কেটে দেন। মানুষের কাছ থেকে কাপড় এনে এই মানুষগুলোকে দেন। আর এ কাজগুলো তিনি নিজেই করেন। সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করার চেষ্টা করেন।
শিপন ২০১৬ সাল থেকে হরমোন জটিলতায় ভুগছেন। অস্ত্রোপচারে অনেক খরচ, তাই নিয়মিত ফলোআপ ও ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক। শিপন বললেন, ‘ আজ প্রায় এক বছর পার হয়ে গেছে, চেক আপ করতে পারিনি। আল্লাহ কে ডেকে ডেকে আর ওষুধ খেয়ে চালিয়ে যাচ্ছি।’

ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন পে ইট ফরওয়ার্ড, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং চট্টগ্রামের কর কমিশনার বাদল সৈয়দ মুঠোফোনে বললেন,‘ শিপন খুব সহজ সরল এবং ভালো ছেলে। ও যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। শিপনের বাংলা বিভাগের তখনকার শিক্ষক ড. মহীবুল আজীজ শিপনের আর্থিক অবস্থার কথা বলে আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমাদের সংগঠনের বাংলাদেশে থাকা এক কোরিয়ান বন্ধু চট্টগ্রাম ইপিজেডের ক্যাঙ বুক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হ্যাং মি লি শিপনের দায়িত্ব। তিনি শিপনকে মাসিক ছয় হাজার টাকাসহ অন্যান্য সহায়তা করছেন। আমাদের এই কোরিয়ান বন্ধুকে শিপন মা ডাকে।’

বাদল সৈয়দ বললেন, ‘শিপন এখন একটি চাকরি খুঁজছে। আমরাও চাই ও একটি ভালো চাকরি পাক। ওর আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর। করোনায় টিউশনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাকে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে সে গ্রামে গিয়ে বর্গা চাষ করছে। শিপনের মতো সারা দেশে এক হাজারের বেশি ছেলে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন পে ইট ফরওয়ার্ডের বন্ধুরা। আমরা এই বন্ধুদের ডোনার বলি না, বলি অভিভাবক। এবং কোনো অভিভাবক একা খরচ সামলাতে না পারলে অন্য অভিভাবকেরা এগিয়ে আসেন। শিপনের যত দিন সহায়তা প্রয়োজন তত দিন আমরা শিপনের পাশে আছি।’

শিপন বললেন,‘বাদল বাবা, মা লিসহ অনেক অভিভাবক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বলেই জীবনে কিছু একটা করে খেতে পারছি বা এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর কম করে হলেও ২০ থেকে ২৫ জনের কাছে কয়েক হাজার টাকা ধার চেয়ে তা পাইনি। জমি বন্ধক রেখে পরীক্ষার ফি দিতে হয়েছিল।’
তবে এত কষ্টের মধ্যেও শিপনের কণ্ঠের হাসির শব্দ মুঠোফোন ভেদ করে কানে আসে। বললেন,‘বাবা যে ঋণ রেখে গিয়েছিলেন তা সব শোধ করে দিয়েছি। এখন একটা চাকরি হলেই মাকে নিয়ে একটু ভালো ভাবে থাকতে পারব।’

শিপন বললেন,‘ঢাকা বা অন্য কোনো জায়গা থেকে কেউ আমার খোঁজ করেছেন এ বিষয় জানতে পারলেই মা ভাবেন, এইবার মনে হয় আমার চাকরি হয়েছে, সেই খবর দেওয়ার জন্যই আমাকে খুঁজছেন কেউ। আমার এখন একটি চাকরি খুব জরুরি। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিসিএস) ননক্যাডার ভাইবা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য দরখাস্ত করছি। এখন শুধু অভাব আর অভাব।’