বিদেশে ক্ষমায় ছাড়া পেয়ে এখন দেশের কারাগারে বন্দী তাঁরা

প্রতীকী ছবি। এএফপি
প্রতীকী ছবি। এএফপি

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিভিন্ন দেশের দণ্ডপ্রাপ্ত অভিবাসীদের বিশেষ ক্ষমা বা সাজা মওকুফ করা হলেও দেশে ফেরার পর তাঁদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। বিমানবন্দর থেকেই মুক্তি পাওয়া এই বন্দীদের কোয়ারেন্টিনে নেওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। এই প্রবাসীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিয়োগ, কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় তাঁরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছেন। এ পর্যন্ত দুই দফায় কাতার, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে আসা ২৫৫ জন বন্দীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে নাশকতা-জঙ্গিবাদসহ অন্য মামলা দেওয়া হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

আইনজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে যেখানে এই বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে ফেরার পর তাঁদের সরাসরি কারাগারে পাঠানো বেআইনি ও অমানবিক। তাঁরা কেউও বন্দী হিসেবে দেশে ফেরেননি। তাঁদের কাউকে সরকার কোনো চুক্তির মাধ্যমে ফেরতও আনেনি। তাঁরা প্রশ্ন রেখে বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দুই দফায় ২৫৫ জন প্রবাসী কীভাবে একসঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন? শুধু সন্দেহ করে ৫৪ ধারায় এভাবে প্রবাসীদের আটক করা মানবাধিকার লঙ্ঘন।

বিশেষ ক্ষমা পাওয়া এই বন্দীদের কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তাঁরা যেহেতু বিদেশেও অপরাধ করে ফিরেছেন, তাই তাঁদের বিষয়ে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

সাজা মওকুফ হওয়া এসব প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের ৩০ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে।

সাজা মওকুফ হওয়া কুয়েত থেকে ফেরা কুমিল্লার শাজাহানের স্ত্রী শারমিন এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী ১৭ বছর ধরে কুয়েত থাকেন। তিন বছর আগে মাদকসেবনের মামলায় আটক হন। এরপর থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। পরে বাংলাদেশে ফিরে কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় ফোন করলে তিনি যোগাযোগ করেন। তাঁকে একটা মুঠোফোন কিনে দেন। এরপর আর যোগাযোগ করতে পারেননি। কুয়েতে তাঁর স্বামী খাবার ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন।

সাজা মওকুফ হওয়া ফেনীর আবদুল্লাহ আল নাইমের স্ত্রী রোকসানা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী কুয়েতে ফাইভ স্টার হোটেলে চাকরি করতেন। এক বছর আগে সন্দেহজনকভাবে তাঁকে আটক করে দেড় বছরের সাজা দেওয়া হয়। এই দুই পরিবারসহ বিদেশ থেকে ফেরত আসা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাঁরা সবাই অধর্কের বেশি সাজা খেটেছেন। করোনাভাইরাসের জন্য তাঁদের বিদেশের সরকার ছেড়ে দিয়েছে। বিদেশের কারাগারে থাকার সময় তাঁরা সেখানে কাজ করে টাকা পাঠাতেন আর বাংলাদেশে আসার পর কারাগার থেকে পরিবারের কাছে টাকা চাইছে। যাঁরা তদন্ত করতে বাড়িতে যাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে টাকা চাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে ক্ষমা পেয়েছেন, কিন্তু এখনো বাংলাদেশে আসেননি—এমন কয়েকজন বন্দীর সঙ্গে বিশেষ মাধ্যমে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা জানান, দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় কাতারের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সরিয়ে শতাধিক বাংলাদেশি বন্দীকে বর্তমানে বিশেষ পুলিশের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে, যা কাতারে সফর জেল হিসেবে পরিচিত। সেখান থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২৬ বছর বয়সী সিলেটের এক তরুণ প্রবাসী জানান, দুই বছর আগে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে মাদক (গাঁজা) মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। এতে কাতারের আদালতে তাঁর দুই বছরের সাজা হয়। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি গ্রেপ্তার হন। এক বছরের বেশি সময় ধরে সাজা ভোগ করার পর চলতি বছর আমিরের বিশেষ ক্ষমা পাওয়া বন্দীদের তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে কাজের জন্য কাতারে এসেছিলেন। কিন্তু জীবনটা শেষ হয়ে গেল। দেশে তাঁর মা-বাবা ও পরিবার অনেক কষ্টে আছে। এখন যদি দেশে গিয়ে আবারও কারাগারে যেতে হয়, তবে ভাগ্যে কী নেমে আসবে, তা ভাবতে পারছেন না। আলাপকালে এই তরুণের সঙ্গে থাকা আরও বেশ কয়েকজন ক্ষমাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি প্রবাসী বন্দী বলেন, কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে তাঁদের অনেকের বাড়িতে গিয়ে পুলিশ তথ্য যাচাই করছে। গাড়ির টায়ার চুরির অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত এক প্রবাসী বন্দী বলেন, তিনি ১০ মাস ধরে কারাগারে বন্দী। তাঁর ছয় মাসের সাজা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে বাড়তি চার মাস তাঁকে বন্দী থাকতে হচ্ছে। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দেশে ফেরার পর আটক করা হলে অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবেন তিনি।

কাতারে ক্ষমাপ্রাপ্ত বন্দীরা দেশে ফেরার পর আটকের বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশ দূতাবাস অবগত নয় বলে জানান রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদ। তিনি বলেন, ‘আমি পত্রিকায় দেখেছি, কিন্তু এ সম্পর্কে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তুরাগ থানার দায়ের করা সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়, এই ব্যক্তিরা বিদেশে অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। যার ফলে শ্রমবাজারে প্রভাব ফেলেছে। তাঁদের সঠিক নাম–ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে খুন, ডাকাতি, জঙ্গি, নাশকতামূলক কমর্কাণ্ডসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত হতে পরেন। ভবিষ্যতে তাঁদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সাজা মওকুফ হওয়া এই বন্দীরা উত্তরা দিয়াবাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য সলাপরামর্শ করছিলেন বলে অভিযোগ এনে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে আদালতকে বলা হয়, পুলিশ গোপন সূত্রে ওই সলাপরামর্শের খবর জানতে পেরেছে। গ্রুপভিত্তিকভাবে সরবকার ও রাষ্ট্রবিরোধী কমর্সূচি পালন করাসহ বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক কমর্কাণ্ড করার জন্য তাঁদের ছেড়ে দিলে দেশে চুরি-ডাকাতি বাড়তে পারে বলেও আবেদনে উল্লেখ করা হয়। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে রিমান্ডে নেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, তাঁরা অপরাধ করেছেন বিদেশে, বিদেশে তাঁদের বিচারও হয়েছে। এই দেশে এনে আবার তাঁদের বিচার করা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। একটা বিষয় সরকারকে বুঝতে হবে যে তাঁদের বন্দী হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ফেরত পাঠায়নি। ক্ষমতা প্রয়োগ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। 

আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এটা সম্পূণ বেআইনি। বিদেশে যদি সাজা খাটা শেষ হয় বা সাজা মওকুফ হয়, তাহলে বাংলাদেশে সাজা খাটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। তাঁরা বিদেশে অপরাধ করেছেন, বাংলাদেশে অপরাধ করেননি। আইনুযায়ী কেউ অপরাধ করলেই তাঁকে আটক করতে পারবে। কেউ গরু চুরি করতে পারে, সেই সন্দেহে তাকে আগেই আটক করা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজকর্ম দেখে মনে হয়, তারা আইন বোঝে না। আর তাঁদের আটকের যাঁরা নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁরা আইনের তোয়াক্কা করেন না।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে ৫৪ ধারায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ডিবি হেফাজতে তাঁর মৃত্যুর পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে ১১ দফা সুপারিশ করে। সুপারিশ মানা না হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ (আসক) বেশ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তি। ওই রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হক ও বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলেও আগের রায়ই বহাল থাকে। তারপরও ৫৪ ধারায় হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার থেমে নেই বলে মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ রয়েছে।