করোনায় প্রবাসী স্বজনের টাকা আসা বন্ধ, তার ওপর বন্যার হানা

শরীয়তপুরের নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকার লোকমান হোসেনের ছেলে থাকেন সৌদি আরবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাস ধরে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি ছেলে। কৃষি ফসলের উপর নির্ভর করে চলছিল পরিবারটি। বন্যায় তাও তলিয়ে গেছে। গতকাল শনিবার দুপুরে তোলা ছবি। ছবি: প্রথম আলো
শরীয়তপুরের নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকার লোকমান হোসেনের ছেলে থাকেন সৌদি আরবে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গত কয়েক মাস ধরে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি ছেলে। কৃষি ফসলের উপর নির্ভর করে চলছিল পরিবারটি। বন্যায় তাও তলিয়ে গেছে। গতকাল শনিবার দুপুরে তোলা ছবি। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মূলপাড়া গ্রামের রুপবান বেগমের স্বামী মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। সংসারের কষ্ট ঘোচাতে স্বামীর রেখে যাওয়া জমি বিক্রি করে দুই ছেলেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাঠান। তাদের পাঠানো টাকায় বেশ ভালোভাবেই চলছিল সংসার। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত জানুয়ারি মাস থেকে ছেলেরা বাড়িতে কোনো টাকা পাঠাতে পারছেন না। দিন চালানোই যেখানে কঠিন হয়ে গেছে, সেখানে ঈদের আনন্দ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই পরিবারটি।

রুপবান বেগম গতকাল শনিবার ঈদের দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম তিন-চার মাস জমানো টাকা দিয়ে সংসার চালিয়েছেন। এর পর থেকে ঋণ করে চলছেন। দুই ঈদের কোনোটাতেই পরিবারের জন্য বিশেষ কোনো আয়োজন করতে পারেননি। রোজার ঈদে পুত্রবধূ ও নাতিদের নতুন পোশাক দিতে পারলেও কোরবানির ঈদে কিছুই করতে পারেননি। আত্মীয়দের দেওয়া মাংস রান্না করে খেয়েছেন তাঁরা।

রুপবান বেগমের ছেলে সাইফুল ইসলাম সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নয় মাস ধরে কাজ বন্ধ। বসে খেয়েছি। বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারিনি। কিছুদিন হলো কাজ শুরু করেছি, কিন্তু এখনো বেতন পাইনি। বাড়িতে স্ত্রী–সন্তান আর মা আছে। তাদের জন্য কিছুই করতে পারছি না। আগে ঈদ এলে আগে পরিবারের জন্য বাড়তি টাকা পাঠাতাম। সেই টাকা দিয়ে পরিবারের সদস্যরা ঈদে আনন্দ করত। কিন্তু এ বছর আমাদের কষ্টের বছর। যার দুই ছেলে বিদেশ থাকে, সেই মাকে আত্মীয়দের কোরবানির মাংসর জন্য অপেক্ষা করতে হয়; এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে?’

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের ছয়টি উপজেলার অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বিদেশে থাকেন। করোনার কারণে তাদের অধিকাংশই কাজ হারিয়েছেন। অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে পরিবারের জন্য টাকা পাঠাতে পারেননি। অধিকাংশের পরিবারই দেশে কষ্টের মধ্যে আছেন।

নড়িয়ার মোক্তারের চর এলাকার লোকমান হোসেনে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সংসারের অভাব দূর করতে ছেলে দোলোয়ার হোসেনকে সৌদি আরবে পাঠান। সেখানে একটি জুতার কারখানায় কাজ করেন তিনি। করোনার কারণে সাত মাস ধরে কারখানাটি বন্ধ ছিল। ফলে কোনো বেতনও পাননি দেলোয়ার। তাঁর খাবার খরচ ও বাসা ভাড়া দিতে হয়েছে ঋণ করে। দেশে টাকা পাঠাতে পারেননি। এদিকে বন্যায় লোকমানের কৃষি ফসল তলিয়ে গেছে। এলাকায় কোনো কাজ নেই। সব মিলিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।

লোকমান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাক-সবজি ও কৃষি ফসল বিক্রি করে আর ছেলের পাঠানো টাকায় বেশ ভালোভাবেই সংসার চলছিল। কিন্তু করোনার কারণে ছেলে টাকা পাঠাতে পারে না। সাত মাস ধরে কৃষির আয় দিয়ে সংসার চলছিল। কিন্তু বন্যায় ফসলের খেত নষ্ট হয়ে গেছে। শাক-সবজি ও ফসল তলিয়ে গেছে। দুটি গরু বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটানোর ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বন্যার কারণে তাও বিক্রি করতে পারিনি। এমন পরিস্থিতিতে ঈদের আয়োজন করব কীভাবে? ঈদের কোনো আয়োজন করতে পারিনি বলে পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পেয়েছে; কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় তা মেনে নিয়েছে।’

নড়িয়ার মোক্তারের চর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শাহ আলম চৌকিদার বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ বিদেশে থাকেন। করোনার কারণে তাদের অনেকেই পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকা পাঠাতে পারেন না। তাদের টাকায়ই বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তানের সংসার চলে। আমরা অনেককে সরকারি বিভিন্ন সুবিধার আওতায় এনেছি। এই ঈদে অনেক পরিবার কষ্টে কাটিয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্যা তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে।’

নড়িয়ার লোনসিং এলাকার নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইতালির রোমে থাকেন। সেখানে একটি রেঁস্তোরায় কাজ করেন তিনি। গত জানুয়ারি মাস থেকে তাঁর কাজ বন্ধ। ফলে তিনি দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। বন্যায় পরিবারটির বসতঘরে পানি উঠেছে। পাঁচ সদস্যর ওই পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন লোনসিং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে।

গতকাল ওই ব্যক্তির স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার পানি ঘরে উঠেছে তা কোনো বিষয় নয়। পানি নেমে যাবে, আমরা বাড়ি ফিরে যাব। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কীভাবে বাঁচব? আমাদের কাছে তো কোনো টাকা নেই। স্বামীর কাজ নেই। তিনি টাকা পাঠাতে পারছেন না। আর স্বামী বিদেশ থাকে বলে কেউ কোনো সহায়তাও কেউ করছেন না। অন্যান্য বছর কোরবানি দিতাম। এ বছর তো সংসার চালাতেই ঋণ করতে হচ্ছে, কোরবানি দিব কীভাবে?’

জানতে চাইলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীয়তপুরের অনেক মানুষ প্রবাসে থাকেন। তাদের পাঠানো অর্থে পরিবারের সদস্যরা চলেন। কিন্তু করোনার কারণে প্রবাসীদের অধিকাংশই টাকা পাঠাতে পারছেন না। ওই পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। অসহায় মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকারের নানা ধরনের কর্মসূচি আছে। তাদের সহায়তা করতে ইউপি চেযারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া আছে।’