ঈদের নামাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলেন তিনি

স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে এসআই হাফিজুর রহমানের পারিবারিক ছবি। এখন তিনি শুধুই ফ্রেমে বন্দী। ছবি: সংগৃহীত
স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে এসআই হাফিজুর রহমানের পারিবারিক ছবি। এখন তিনি শুধুই ফ্রেমে বন্দী। ছবি: সংগৃহীত

এমন হাহাকারের ঈদ আগে কখনো আসেনি আশিকুর রহমান ওরফে টুটুলের (২২) জীবনে। ঈদের দিন অন্যবারের মতো এবারও মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন। তবে প্রথমবারের মতো এবার সঙ্গী হননি বাবা। প্রথমবারের মতো বাবার হাতে সেমাই না খেয়ে নামাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। আশিকুরের মতো অনেক পরিবার করোনাভাইরাসে প্রিয়জন হারিয়েছে। এ বেদনা সঙ্গী করে তাঁরা এবার ঈদ পালন করেছেন।

বিবিএ সমাপনী বর্ষের শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান ঢাকার একটি কলেজে পড়াশোনা করেন। আগের ঈদগুলোতে সকালে বাবার হাতে সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যেতেন। নামাজ পড়ে বাবার সঙ্গে ফিরতেন বাড়িতে। গতকাল শনিবার বাবাকে ছাড়া একা কাঁদতে কাঁদতে তিনি ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরেন।

হাফিজুর রহমান (৫৬) পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। ফরিদপুর আদালতে কর্মরত ছিলেন। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে তিনি গত ২৯ জুন রাত সাড়ে ১২টায় মারা যান। মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

হাফিজুরের স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম লাকী আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রয়াত স্বামীর কথা বলতে গিয়ে। তিনি বলেন, ‘কী বলব ঈদের কথা! আমাদের তো ঈদ বলতে কিছু ছিল না। আমি, আমার ছেলেমেয়ে কখনো তাঁকে ছাড়া ঈদ করিনি। যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, ঈদের আগের দিন বা ঈদের দিন ভোরে তিনি বাড়িতে চলে আসতেন সবার সঙ্গে ঈদ করার জন্য।’

দেলোয়ারা বেগম বলেন, ‘ছেলে এবারই প্রথম বাবাকে ছাড়া ঈদের নামাজ পড়তে গেল। কাঁদতে কাঁদতে ফরিদপুর শহরের চাঁনমারী মসজিদে গেছে, আবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। ওর দিকে তাকাতে পারিনি মা হিসেবে। মেয়ে ফারজানা রহমান সেতুরও (২৫) একই অবস্থা। বৃদ্ধ শাশুড়ি ঈদের আগের দিন থেকে অনবরত কান্নাকাটি করেছেন।’

‘ঈদের দিন বাবার সঙ্গে নামাজ পড়া ছিল প্রিয় সময়’

ঈদের আনন্দ ছিল না ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের টোনা গ্রামের আবুল খায়েরের (৬৮) পরিবারে। আবুল খায়ের বোয়ালমারী উপজেলার জয় নগর পুলিশ ফাঁড়িতে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ২৬ জুন তিনি জ্বর, কাশি, সর্দির উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে ঢাকার তেজগাঁওয়ের ইমপালস হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ১০ দিন তিনি নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিলেন। মারা যান ১০ জুলাই। মারা যাওয়ার পর তাঁর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পজিটিভ আসে।

আবুল খায়েরের স্ত্রীর নাম হাওয়া বেগম। এক ছেলে ও এক মেয়ের রয়েছে তাঁদের। ছেলে তানভীর হোসেন (২১) যশোর নওপাড়া এলাকার একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অষ্টম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। মেয়ে শামীমা খাতুন (২৩) অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।

মৃত আবুল খায়েরের ছেলে তানভীর হোসেন জানান, ‘ঈদ বেশির ভাগ সময় বাবার সঙ্গেই করতাম। বাবা ছুটি না পাওয়ায় জীবনে হয়তো দু-একবার তাঁকে ছাড়া ঈদ করতে হয়েছে। সেমাই খেয়ে বাবার সঙ্গে নামাজ পড়তে যাওয়া ছিল ঈদের দিন আমার প্রিয় সময়। এবার বাবার অভাব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছি। মাথার ওপর একটি বটগাছ হয়ে ছিলেন বাবা। আমাদের শূন্য করে চলে গেলেন।’

স্ত্রীর শোক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপের ঈদ

স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে অনেক আক্ষেপ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সারোয়ার খানের (৬৮)। স্ত্রীর শোক নিয়েই ঈদের দিনটি পার করলেন। স্ত্রী লুৎফুন খানম (৫০) কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে ২৩ জুন মারা যান। মৃত্যুর সময় লুৎফুন খানম স্বামীর সঙ্গে রেখে গেছেন দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরুল্লাগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ গঙ্গাধরদী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ারের বাড়ি। স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে তাঁর অনেক অভিযোগ। বললেন, ‘আমার স্ত্রীকে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলা হয়েছে। ২১ জুন তাঁর নমুনা দিই ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তারা কোনো চিকিৎসা না দিয়ে বলে চার দিন পর রিপোর্ট পাবেন। পরে আমার স্ত্রীকে ফরিদপুরের করোনাভাইরাস ডেডিকেটেড হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। আইসিইতে রাখা হয়। সেখানে ২৩ জুন তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর রিপোর্ট দেয় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পজিটিভ ছিল।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার বলেন, ‘আমি স্বাস্থ্য পরিদর্শক ছিলাম। অবসরে গেছি ২০১৪ সালের ৪ জুন। তখনো স্বাস্থ্য বিভাগের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। এখন হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা নেই। আমি কাউকে ছাড়ব না।’