শিশুদের মুখে ডান্ডি, দেখার কেউ নেই

ইব্রাহীম আর হাসান (ছদ্মনাম) দুই বন্ধু। দুজনের বয়সই সাত বছর।

ইব্রাহীম হাসানকে দোস্ত বলে ডাকে। হাসানও ইব্রাহীমকে দোস্ত বলে ডাকে। দিনের বেশির ভাগ সময় তারা একসঙ্গে থাকে। একসঙ্গে খায়। হাসানের বাবা আছে, মা নেই। ইব্রাহীমের মা আছে, বাবা নেই।

হাসান জানে না তাঁর গ্রামের বাড়ি কোথায়, তবে ইব্রাহীম জানে তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে। কয়েক বছর আগে হাসান ট্রেনে করে কমলাপুর রেলস্টেশনে নামে। আর ইব্রাহীম মায়ের সঙ্গে ঢাকায় আসে।


বছর দুয়েক আগে যাত্রাবাড়ীর মোড়ে তাদের পরিচয়। সেই থেকে তারা বন্ধু।


রোববার দুপুরে দেখা গেল, ঢাকা-মাওয়া সড়কের পোস্তগোলা অংশে দুজন ‘ডান্ডি’ সেবন করছে। ডান্ডি হলো একধরনের আঠা।

মাদকসেবীরা ডান্ডি নামের এই আঠা প্রথমে পলিথিনের ভেতর ঢোকায়। এরপর পলিথিন থেকে মুখ ও নাকের মধ্য দিয়ে ভেতরে টেনে নেয়।


হাসান বলছিল, ‘আমার মা অনেক আগে মারা গেছে। আমি বাবার কাছে ছিলাম। তবে বাবা আমাকে একদিন মারধর করে। আমি ঢাকায় চলে আসি। এখন রাস্তায় রাস্তায় থাকি। আমার কিছুই ভালো লাগে না। সারা দিন আমি ভিক্ষা করি।’

তবে ইব্রাহীম বলল, ‘আমার বাবা নেই, মা আছে। আমার মা ঢাকায় থাকে। মায়ের সঙ্গে আমি থাকি। মা সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকে। হাসানোর মতো আমিও ভিক্ষা করি।’
হাসান ও ইব্রাহীম জানাল, ভিক্ষার টাকা দিয়ে তারা ডান্ডি কিনে তা সেবন করে।

ডান্ডি নামে প্রচলিত মাদক সেবন করলে শিশুদের মনোবৈকল্য দেখা দেয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলালউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডান্ডি নামে প্রচলিত এই আঠায় অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড থাকে। এই আঠা সেবনে শিশুদের আচরণ ও চিন্তার আবেগকে পরিবর্তন করে। মূলত, শহরের ছিন্নমূল শিশুরা ডান্ডি নামের এই মাদক সেবন করছে। এতে এসব শিশুর মস্তিষ্কের নানা বৈকল্য হয়।

হেলালউদ্দিন আহমেদ জানান, ডান্ডি সেবনকারী অনেক শিশুকে তাঁদের কাছে নিয়ে আসা হয়। মূলত, এসব শিশু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের ভেতর নানান হতাশা কাজ করে। এসব হতাশা ভুলতে তারা ডান্ডি সেবন করে। এসব শিশুর পুনর্বাসন খুব জরুরি।

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার, সদরঘাট, বাবুবাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, মহাখালী ও কমলাপুর রেলস্টেশন ঘুরে দেখা গেল, ইব্রাহীম ও হাসানোর মতো আরও অনেক শিশু ডান্ডি নামের মাদক সেবন করে।

ডান্ডি সেবন করে—এমন কয়েকজন শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব ভবঘুরে শিশুর কারও বাবা আছে, কিন্তু মা নেই। আবার কারও মা আছে, কিন্তু বাবা নেই। প্রায় সবাই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। বোতলসহ রাস্তায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করে তা ভাঙাড়ি দোকানে বিক্রি করে। আবার অনেক শিশু ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। এসব শিশু ডান্ডি সংগ্রহ করে পেশাদার মাদকসেবীদের কাছ থেকে।

ঢাকা-মাওয়া সড়কে ডান্ডি সেবন করছে দুই শিশু। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঢাকা-মাওয়া সড়কে ডান্ডি সেবন করছে দুই শিশু। ছবি: আসাদুজ্জামান

গত ৮ মার্চ দেশে করোনা শনাক্তের পর ঢাকা মহানগরের এসব ভবঘুরে শিশুর বিপদ আরও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে যখন শহরের হোটেলগুলো বন্ধ হয়ে যায়, তখন এসব শিশুকে খাবারের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। ভবঘুরে এসব শিশুর অনেকে শহরের হোটেলগুলোয় খাওয়াদাওয়া করে।

রাজধানীর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নিচে সায়েদাবাদের টার্মিনালের পাশে, কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনে অনেক শিশুকে নিয়মিত ডান্ডি সেবন করতে দেখা যায়। এ ছাড়া সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ও ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সামনে, কারওয়ান বাজার উড়ালসড়কের ওপরেও নিয়মিত ডান্ডি সেবন করে অনেক শিশু।

ঈদের এই সময়ে অন্য শিশুরা যখন ঘরে মা-বাবার কাছে নিরাপদে আছে, তখন ছিন্নমূল এসব শিশু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। বেঁচে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। ঈদের আনন্দ বলে তাদের কাছে কিছু নেই। বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে বড় বিষয়।

মাদকসেবী এসব শিশুর পুনর্বাসন ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে ঢাকা মহানগরের বহু শিশু যে ডান্ডি সেবন করে, বিষয়টি ভালোভাবেই জানে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির ভবঘুরে কার্যক্রম দেখভালকারী উপপরিচালক বেগম সাঈদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জানি, ঢাকা মহানগরীর বহু ভবঘুরে শিশু ডান্ডি নামের মাদক সেবন করে থাকে। এসব ভবঘুরে শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকের মা-বাবা নেই। এসব ভবঘুরে শিশুর কল্যাণে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনেক কর্মসূচি রয়েছে। অনেক শিশুকে ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়। তবে ঢাকাসহ ভবঘুরে শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা খুবই কম।’

বেগম সাঈদা আখতার জানান, ঢাকাসহ সারা দেশে ভবঘুরেদের রাখার জন্য মাত্র পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ঢাকায় রয়েছে মাত্র একটি। সেখানে মাত্র ৭০ জনকে রাখা যায়। সব মিলিয়ে সারা দেশে পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজারের মতো ভবঘুরেকে রাখা হয়েছে। তবে যত ভবঘুরে রয়েছে, সেই তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা একেবারই কম। আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো খুবই জরুরি।

ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর যদি আমাদের লিখিতভাবে জানায় যে ভবঘুরে শিশুদের কল্যাণে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা দরকার, আমরা তা করব। কারণ, এসব ছোট্ট ছোট্ট শিশু মাদক সেবন করছে, এর থেকে খারাপ কোনো খবর হতে পারে না। সবাই মিলে এসব ভবঘুরে শিশুকে স্বাভাবিক আর দশটি বাচ্চার মতো বড় হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে চাই। নগরের একজন সেবক হিসেব আমি এসব অসহায় শিশুর পাশে থাকব। এসব শিশুর কল্যাণে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’