'ঈদের দিন ডিম ভাজা দিয়া ভাত খাবার নাগচি'

গাইবান্ধার বালাসি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আবদুল মালেক (৫৫)। প্রায় এক মাস আগে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এখনো হাঁটুপানি। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সংলগ্ন বাঁধে উঠেছেন। সেখানে একচালা ঘরে প্রায় এক মাস ধরে বসবাস করছেন। কোরবানি দিতে পারেননি, কেউ দিয়ে যায়নি মাংসও। ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় আবদুল মালেক ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধার বালাসি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আবদুল মালেক (৫৫)। প্রায় এক মাস আগে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এখনো হাঁটুপানি। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সংলগ্ন বাঁধে উঠেছেন। সেখানে একচালা ঘরে প্রায় এক মাস ধরে বসবাস করছেন। কোরবানি দিতে পারেননি, কেউ দিয়ে যায়নি মাংসও। ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় আবদুল মালেক ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধার বালাসি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক আবদুল মালেক (৫৫)। বালাসি গ্রামটি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। গ্রামের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বাঁধসংলগ্ন আবদুল মালেকের বাড়ি। বাড়িতে একটি টিনশেড ঘর, একটি রান্নাঘর ও একটি শৌচাগার রয়েছে। প্রায় এক মাস আগে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে যায়। এখনো হাঁটুপানি। ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সংলগ্ন বাঁধে উঠেছেন। সেখানে একচালা ঘরে প্রায় এক মাস ধরে বসবাস করছেন। এক ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ও দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চলে।

ঈদের দিন বিকেল পাঁচটায় আবদুল মালেকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। কোরবানি করেননি? জানতে চাইলে আবদুল মালেক বললেন, ‘দ্যাখপার নাগচেন না, ক্যামন আচি। পোত্তেকব্যার পালা (পোষা) ছাগল দিয়া কুরবেনি দেই। এব্যারক্যা দিব্যার পাই নাই। করোনা আর বানের মদ্দে কাম করব্যার পাই নাই। দুকনে ছাগল আচিলো। তাক ১০ হাজার ট্যাকা বেচি সোংসার চলাচি। সেই ট্যাকাও শ্যাষ হচে। ধারদেনা করি সোংসার চালবার নাগচি। কুরবেনি করমো ক্যামন করি। ট্যাকা নাই, হাঁস-মুরগি কিনব্যার পাই নাই। তাই ঈদের দিন ডিম ভাজা দিয়া ভাত খাবার নাগচি। কাইয়ো যদি গোসতো দ্যায়, তাক ছোলপোলোক খিলামো।’

গাইবান্ধা জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার ছয়টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়ন এখনো প্লাবিত হয়ে আছে। পানিবন্দী হয়ে আছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। তাঁরা বাঁধ ও উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। পানি কিছুটা কমলেও তাঁরা ঘরে ফিরতে পারেনি। এ ছাড়া বন্যার কারণে ৩৫ হাজার ৫৫১টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল শনিবার ও আজ রোববার বন্যার্ত মানুষের ঈদ উদযাপনের চিত্র দেখতে বের হয়ে দেখা গেছে, আবদুল মালেকের মতো এবার গাইবান্ধার বন্যার্ত মানুষের নিরানন্দ ঈদ কাটছে।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাঁধটি রংপুরের কাউনিয়া থেকে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। এই বাঁধের প্রায় ৯৮ কিলোমিটার গাইবান্ধা জেলার সীমানায় পড়েছে। এর মধ্যে ফুলছড়ি উপজেলার অংশে সহস্রাধিক বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় তারা বাঁধে আশ্রয় নেয়। ফুলছড়ি উপজেলা ছাড়াও সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর ও সাঘাটা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

বন্যায় এলাকার মসজিদ ডুবে গেছে। তাই নৌকাযোগে দূরের মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। ঈদের দিন সকালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ভাষারপাড়া গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
বন্যায় এলাকার মসজিদ ডুবে গেছে। তাই নৌকাযোগে দূরের মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। ঈদের দিন সকালে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ভাষারপাড়া গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন ফুলছড়ি উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের দিনমজুর আবদুল জলিল (৪২)। তিনি বলেন, ‘বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে এই বাঁধে বসবাস করছি। সঙ্গে গবাদিপশু, হাঁসমুরগি নিয়ে এসেছি। প্রায় এক মাস থেকে এখানে আছি। কোরবানি করা দূরের কথা, খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছে।’ ফুলছড়ির কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ঘোলদহ গ্রামের কৃষক জিয়াউল হক (৪৮) বলেন, ‘এবারের বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট হয়েছে। খেয়ে না-খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। কোরবানি করব কীভাবে?’

কঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিটন মিয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ৮ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। করোনা ও বন্যার কারণে তাঁদের নিরানন্দ ঈদ কাটল।’

গত সাড়ে চার মাস ধরে করোনা ও এক মাসের বেশি সময় চলা বন্যায় গাইবান্ধার সাত উপজেলার বানভাসি মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। এবার ঈদে আনন্দের বদলে এসব মানুষের ঈদ কেটেছে নিরানন্দে। যাঁরা প্রতিবছর কোরবানি দেন, এবার তাঁদের চেয়ে থাকতে হয়েছে অন্যরা কতক্ষণে মাংস দিয়ে যাবেন, সেদিকে।

ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বালাসি গ্রামের ব্যবসায়ী সবুর মিয়া (৪৫) নিজের ভাষায় বললেন, ‘করোনার জন্যে একে তো বেচাবিক্রি কম হচে। কোনোমতে দিনগুল্যা কাটাচি। তার উপরোত এবারক্যা এক মাসোতে তিনব্যারের বানোত দোকানের মালগুল্যা সব পানিত ভিজি নষ্ট হচে। হামরা শ্যাস হয়্যা গেলাম গো ভাই। সব শ্যাস হয়্যা গেল। এখন কিস্তির ট্যাকা শোধ করব্যার নাগচি মহাজনের কাছোত থাকি সুদের উপরোত ট্যাকা নিয়্যা। হামরা মানুষগুল্যা সারা দিন ঘরোতে সময় কাটাচি। গোশত কিনব্যারও পাই নাই। খালি সেমাই খায়্যা ঈদ করচি। কাঁটোল (কাঁঠাল) সেদ্দ খায়্যা থাকি। বেশি খ্যালে প্যাটও বিষ্যায়। খুব কষ্টোত আচি।’

পার্শ্ববর্তী ভাষারপাড়া গ্রামের বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক জমির উদ্দিন (৪০) বলেন, ‘ঈদ সবার জন্যে আনন্দের হলেও গত ঈদের মতো এবার আনন্দের ছিটেফোঁটাও ছিল না আমাদের কাছে। কেননা করোনার কারণে সাড়ে চার মাস ধরে বিদ্যালয় বন্ধ। এ জন্য কেউ গৃহশিক্ষক হিসেবেও আর রাখেননি। গত ঈদের মতো বউ-বাচ্চাকে ঈদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে তো পারিনি, উল্টো তারাই সান্ত্বনা দিয়েছে কিছু লাগবে না বলে। দিন কাটছে সুদের ওপর টাকা নিয়ে দু-বেলা খেয়ে না-খেয়ে। অন্যান্য বছর ভাগে কোরবানি দিতে পারলেও এবার চেয়ে আছি অন্যরা কতক্ষণে মাংস দিয়ে যাবেন।’

একই গ্রামের পশু ব্যবসায়ী আবদুল জোব্বার বলেন, ‘প্রতিবছর কোরবানির ঈদে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার কোরবানির পশু বিক্রির ব্যবসা করেছি। এবার মাত্র ২৩ লাখ টাকার ব্যবসা করেছি। লাভের মুখ দেখার বদলে এবার লোকসানের শিকার হয়েছি। কেননা করোনার কারণে গত সাড়ে চার মাস ধরে মানুষের ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হওয়ায় হাটে ক্রেতা কম এসেছে। এ জন্য গরুর দামও ছিল নিম্নমুখী। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় গরুর প্রতি নিতে হয়েছে আরও বেশি যত্ন। এ জন্য ব্যয়ও বেড়েছে। আর তাই করোনা ও বন্যার কারণে এবার অনেক খামারিই লোকসানের শিকার হয়েছেন।’