মাসের পর মাস পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন তাঁরা

করোনা পরিস্থিতির কারণে দায়িত্ব বেড়ে গেছে পুলিশ সদস্যদের। মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুর জেলা শহরের রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
করোনা পরিস্থিতির কারণে দায়িত্ব বেড়ে গেছে পুলিশ সদস্যদের। মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুর জেলা শহরের রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলাম। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। দুই সন্তান নিয়ে স্ত্রী থাকেন সেখানে। আট মাস রবিউল পরিবারের কাছে যেতে পারেন না। এরই মধ্যে দুটি ঈদ চলে গেছে; সন্তানদের জন্মদিনও এসেছে আর গেছে। প্রিয়জনের কাছে না যেতে পারার কষ্ট বুকে চেপে রেখে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। রবিউলের মতো শরীয়তপুরে কর্মরত ১ হাজার ১০০ পুলিশ সদস্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে আমি ছুটিতে গিয়েছিলাম। এরপরই দেশে করোনা মহামারি শুরু হয়। বেড়ে যায় পুলিশের কাজ। মানুষকে নিরাপদে রাখতে আমাদের রাস্তায় থাকতে হচ্ছে। অনেক সহকর্মী করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই মাঠে কাজ করছি। যখন ছেলেমেয়েরা ফোন করে, তাদের কাছে যেতে বলে, তখন মনটা বিষাদে ভরে যায়। ঈদে যেতে পারিনি। সন্তানেরাও অনেক কষ্ট পেয়েছে। এমন কষ্ট বুকে চেপেই মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। এ বিপদ থেকে দেশ কবে মুক্তি পাবে জানি না। তখনই আমাদের কষ্টটা কমবে।’

জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, শরীয়তপুরে সাতটি থানা ও পাঁচটি ফাঁড়ির পাশাপাশি পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যক্রম রয়েছে। সব মিলিয়ে জেলায় পুলিশ বিভাগে কর্মরত ১ হাজার ১০০ জন। ১৫০ জন এ পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে কর্মস্থলে ফিরেছেন ১০৭ জন। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে পুলিশ সদস্যদের ছুটি বাতিল করা হয়। কারণ, করোনার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি পুলিশের নানামুখী দায়িত্ব বেড়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, লকডাউন বাস্তবায়ন করা, মানুষের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, করোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের দাফন বা সৎকার করা এবং খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া।

জেলা পুলিশের কনস্টেবল জাকির হোসেনের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা, দুই সন্তান ও স্ত্রী থাকেন। গত জানুয়ারির পর আর তাঁদের কাছে যেতে পারেননি তিনি। পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় গ্রামে যেতে পারেননি। তখন পরিবারের সদস্যদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঈদুল আজহার সময় বাড়িতে গিয়ে সবাই একসঙ্গে ঈদ উদযাপন করবেন। কিন্তু ছুটি না মেলায় সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি।

জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে অনেক কষ্ট। এগুলো বলে আর কী হবে। পুলিশের চাকরি নিয়ে নানা বদনাম রয়েছে। কিন্তু এই চাকরি যে কত বড় ত্যাগের, তা কেউ কখনো আলোচনা করে না। পরিবারের সুখ বিসর্জন দিয়ে, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছি। এই ছয় মাসে মাঠে কাজ করতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। মানুষকে নিরাপদ রাখতে আমরা জীবন বাজি রাখছি। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি কম।’

ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের এসআই মুজাহিদুল ইসলাম গত মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে বিয়ে করেন। কর্মস্থলে ফেরার পরপরই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। গত পাঁচ মাসেও ফিরতে পারেননি স্বজনদের কাছে। এরই মধ্যে দুটি ঈদ এসেছে আর গেছে। পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেননি তিনি। তাতে কিছুটা কষ্ট যেমন আছে, তেমনি সান্ত্বনাও আছে মুজাহিদুলের। তাঁর মতে, দেশের এই ক্রান্তিকালে পরিবারের সুখ দেখার চেয়ে মানুষের পাশে থাকা জরুরি। যখন ভাবেন, মানুষের কল্যাণ হচ্ছে, তখন কষ্ট ভুলে মনে শান্তি পান তিনি।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এস এম আশ্রাফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে পুলিশের প্রতি দায়িত্ব বেড়েছে। মানুষেরও আস্থার জায়গা বেড়েছে। ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ সদস্যরা করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, মৃত ব্যক্তিদের দাফন-সৎকার করা, খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের অনেকের মনেই কষ্ট রয়েছে। তবে দেশের কল্যাণের কথা ভেবে সবাই তা মেনে নিচ্ছেন।