কবে ওদের প্রাণ ভরে ভালোবাসব

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

বিশ্বব্যাপী করোনার দাপট যেন কিছুতেই কমছে না। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। প্রবীণদের বাইরে যেতে মানা। সবাই বলছে, ওগো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।

ছেলে বস্ত্র প্রকৌশলী প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করে। ও বলে, ‘বাবা তুমি আইসোলেসনে থাকো, আমি প্রতিদিন অফিসে যাই, অনেক লোকের সঙ্গে মেলামেশা করি, আমার করোনার সংক্রমণ হতে পারে। বয়স্কদের করোনার ঝুঁকি বেশি, তাই তোমার আইসোলেসনে থাকা ভালো।’ কী করব, তিন মাস ধরে গৃহবন্দী। কিন্তু মন মানে না। ভাবি, এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?

মনে মনে ঠিক করলাম, গ্রামের বাড়ি চলে যাব। সেখানে বাড়িতে থাকার লোক নেই। গ্রামের বাড়িগুলোর অবস্থান দূরে দূরে, মানষের সমাগম নেই, নেই কোনো কোলাহল। যাকে বলে ন্যাচারাল আইসোলেশন। যেই কথা সেই কাজ, বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। সঙ্গে চাল–ডাল, চিড়া–মুড়ি যাবতীয় সঙ্গে নিলাম।
ভাবছি, যাই কী করে? বাসগুলোর যে অবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি কতটুকু মানে কে জানে? ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোতে আমার কাছে বেশি সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকে বলে মনে হলো। তাই একটা অটো ভাড়া করে সাভার থেকে পৌঁছালাম আশুলিয়ার তৈয়বপুর গ্রামের বাড়ি। বাড়ি এসে মনে হলো, বন্দী মুক্ত হলো। ঘরে ঢুকে দেখি, ঘরবাড়ি ধুলায় ধূসর। কাজের বুয়া ডাকব কি না, ভাবছি। আবার ভাবি, শহরের গিন্নি মায়েরা করোনার ভয়ে কাজের মেয়ে বাদ দিয়েছে, আমি কী করে বুয়া ডাকি? নিজেই কাজে লেগে গেলাম। কাপড়চোপড় ধুয়ে শুকাতে গেলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন ঝমঝমিয়ে এল বৃষ্টি। বৃষ্টিভেজা হয়ে গেলাম। এমনিতেই আমি অ্যাজমার রোগী, এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

রাতের বেলা খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে আছি। গা যেন কেমন ঝিমঝিম করছে। বুক ভার ভার লাগছে। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে আজানের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় গড়াগড়ি করতে লাগলাম। পাশের আমগাছের ডালায় বসে ঘুঘু ডাকছে, সূর্যঠাকুর উঠি উঠি। বুঝতে পারলাম, সকাল হয়েছে। বিছানা থেকে উঠে বের হলাম বাড়ির বাইরে। বাড়ির পাশের গোহালটে নেমে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পূর্ব প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। গ্রামের পূর্ব প্রান্ত জুড়ে খোলা আকাশ আর তেপান্তরের মাঠের মতো অবারিত সবুজ মাঠ। মাঠের ওপারে বহুদূরে গ্রামের ছবি ধূ ধূ করছে। গ্রামের অদূরে প্রাচীন এক বটবৃক্ষ একা ঠায় দাঁড়িয়ে। প্রকৃতি নীরব নিথর। চারদিকে সুনসান। প্রকৃতির এক অভিনব সৌন্দর্যে ধরা দিল আমার কাছে। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। এ সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। এভাবে কতক্ষণ কাটল জানি না। ইতিমধ্যে ভোরের সূর্য উদিত হলো পুব আকাশে। কৃষকেরা গরুর পাল নিয়ে ফিরছে মাঠে। আমি বাড়ি ফিরে এলাম।

বড়ি এসে সকালের নাশতা শেষ করলাম। শরীর যেন অবসন্ন হয়ে আসছে। মৃদু ঠান্ডা অনুভব হতে লাগল। সঙ্গে কাশি বেড়ে গেল। শরীর দুর্বল থেকে দুর্বল হতে লাগল। উপায় না দেখে বিছানায় গড়াগড়ি করতে লাগলাম। বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। পাশের বাড়ির বাসা থেকে খাবার চলে এল। কিন্তু খাওয়ায় অরুচি। ভাত গিলতে ইচ্ছা করছে না। কোনো রকমে আধপেটা খেয়ে খাওয়া শেষ করলাম। ঠিক করলাম আবার সাভারের বাসায় চলে যাব।

ইতিমধ্যে আকাশ ছেপে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। অপেক্ষায় আছি কখন বৃষ্টি থামবে। ঘণ্টা ধরে বৃষ্টি। অবশেষে বৃষ্টির গতি কমে এল। ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এ বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। ভাবি, আর অপেক্ষা করা যায় না। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। তাই একখান ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম টেক্সি স্ট্যান্ডে। হাঁটতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। কোনো রকমে পৌঁছালাম টেক্সি স্ট্যান্ড। গিয়ে দেখি, কোনো গাড়ি নেই। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। হঠাৎ মনে পড়ল, ভাড়াটে সোনামিয়ার কথা। বাড়ি রংপুরের কোনো এক গাঁয়ে। সহজ–সরল মানুষ। আমার সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসে। ওকে স্মরণ করলাম। হাইওয়ের পাশ থেকে একটা টেক্সি ক্যাব নিয়ে আসতে বললাম। আমি বাড়ি ফিরে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সোনামিয়া গাড়ি নিয়ে হাজির হলো। আমার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ও আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে সাহায্য করল। আমি সাভারের বাসায় চলে এলাম।

গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল ট্যাক্সিচালক। আমার এ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল বাড়ির লোক। পাশের বাসার লোকজন উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে আমাকে। বউ এসে ধরাধরি করে উঠাল দোতলায় নিজের বাসায়। নিজের রুমে শোয়াল আমাকে। বউ জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার কি গলাব্যথা।’ উত্তর, ‘না।’ ছেলে বলে, ‘বাবা তোমার কি গায়ে জ্বর আছে?’ উত্তর, ‘না।’ ছেলের বউ বলে, ‘বাবা, আপনার কি ঘ্রাণশক্তি কমেছে?’ উত্তর, ‘না’। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। তবে কি বাড়ির লোক সন্দেহ করছে আমাকে করোনা আক্রান্ত বলে? এ উত্তর অজানা। কারণ, এ রোগ দেখা দেয় কিছু উপসর্গ নিয়ে আবার কখনো উপসর্গবিহীন। বাধ্য হয়ে আবার কোয়ারেন্টিনে।

মুখের স্বাদ ও রুচি নেই। খেতে কিছু ভালো লাগছে না। দুবেলা স্যুপ আর এক বেলা আলুসেদ্ধ কিংবা টাকি মাছের ভর্তা খেয়ে বেঁচে আছি। শরীরে শক্তি নেই। বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয়। ঠান্ডা-কাশির জন্য ট্যাবলেট আর দুবেলা ইনহেলার নিচ্ছি। আমি কোনো মনোবল হারাইনি। এভাবে কাটল কয়েক দিন। আস্তে আস্তে শরীরে শক্তি সঞ্চয় হতে লাগল। মুখের রুচি বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে আমি ভালো হয়ে গেছি। কোয়ারেন্টিনের এখনো কয়েক দিন বাকি।

বাসায় আমার তিন নাতনি। বড় মেয়ের মেয়েটি সবার বড়, বয়স আট। ছেলের ঘরের নাতনি মেজ, বয়স পাঁচ আর ছোট মেয়ের মেয়েটির বয়স দেড় বছর।
বড় নাতনি শান্ত প্রকৃতির, ওকে ঘরে ঢুকতে মানা করলে কথা শুনে। কিন্তু মেজটি ভারি দুষ্ট। ও কথা শুনতে চায় না। হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে বলে, দিলাম ছুঁয়ে। সত্যি সত্যি ছুঁয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আবার কাছে এলে আচ্ছা করে বকে দিই। ছোটটি কেবল হাঁটতে শিখেছে এবং আধো আধো বোলে কথা বলতে চেষ্টা করে। ওর মা মানিকগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের এক শাখার কর্মকর্তা। ওদের বাসা আমাদের বাসার কাছে। ওর মা ওকে আমার বাসায় রেখে প্রতিদিন মানিকগঞ্জ যাওয়া–আসা করে। লকডাউনের কারণে মানিকগঞ্জ থাকছে। এখন নাতনিটি আমার বাসায় থাকে। জন্মের পর থেকে ও আমাদের কাছে আছে। এ কারণে আমি ওর কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছি। ও শুধু আমার কাছে আসতে চায়। আমি দুহাত নেড়ে বলি আসে না আসে না। আমার কথা শুনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ও আর আসে না। প্রতিদিন এভাবে দরজার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ঘরের দরজার সামনে মেঝেতে একটা লাল দাগ আছে। ও এই লাল দাগটি অতিক্রম করে না। আমি অবাক হয়ে যাই এ ছোট মেয়েটি বুদ্ধি দেখে । ইচ্ছা করে ওকে দুহাতে কোলে তুলে আদর করি, কিন্তু পারি না করোনার আতঙ্কে। দেশে করোনাভাইরাস আসার পর আমি যেন কেমন গুটিয়ে যাচ্ছি, কারও কাছে যেতে আর কাউকে স্পর্শ করতে ভয় পাই। কারণ সবাই বলে, প্রবীণেরা করোনার ঝুঁকিতে।

দেশ থেকে করোনা কবে যাবে, ওদের আবার দুহাতে কোলে তুলে প্রাণ ভরে আদর করব?