করোনার নমুনা পরীক্ষায় ধারাবাহিকতার ঘাটতি

করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষায় ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় পরীক্ষা কম হচ্ছে। অন্যদিকে পরীক্ষার ফলাফলে সামঞ্জস্য থাকছে না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে পরীক্ষার ওপর জোর দিতে হবে।

দেশে এখন ৮৩টি কেন্দ্র নমুনা পরীক্ষার জন্য চালু আছে। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কমছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৯ জুলাই ১৪ হাজার ১২৭টি নমুনা পরীক্ষার কথা জানিয়েছিল। ৬ দিন পর ৪ আগস্ট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৭ হাজার ৭১২টি। অর্থাৎ নমুনা পরীক্ষা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এই ছয় দিনে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কমে যাওয়ার একটি কারণ পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি। ঈদের দিন, অর্থাৎ ১ আগস্ট নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ৮ হাজার ৮০২টি। কিন্তু এর বিপরীত চিত্র দেখা গিয়েছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন বা ২৫ মে তারিখে। ওই দিন নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল ৯ হাজার ৪৫১টি। সেদিন চালু পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল ৪৮। অর্থাৎ এত দিনে কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়লেও পরীক্ষা বাড়েনি।

পরীক্ষার এই অবস্থা কেন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, কয়েকটি কারণে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কমেছে—ঈদের ছুটি, আরোগ্য পরিস্থিতি জানার জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষা না করানো, বন্যা, ফি নির্ধারণ ও দেশে সংক্রমণ কমে যাওয়া।

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক বলেন, ফি নির্ধারণ বড় কারণ। ফি নেওয়া শুরু হওয়ার পরপরই পরীক্ষা কমতে দেখা গেছে। বন্যা ও ঈদের কারণে পরীক্ষা কিছু কমেছে। তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর আস্থা নেই বলে অনেকেই আর পরীক্ষা করাতে চান না। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা জরুরি। আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ), কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ), চিকিৎসা—যা কিছুই করা হোক না কেন, শুরুতে দরকার পরীক্ষা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনা মহামারির শুরু থেকে বারবার পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন। সন্দেহভাজন প্রত্যেকটি মানুষকে পরীক্ষা করুন।

দেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় দৈনিক ২৪ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরাও একাধিকবার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে বলেছেন। কিন্তু এক দিনের জন্যও ২০ হাজার পরীক্ষা দেশে হয়নি।

অভিযোগ আছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুরু থেকেই এই জায়গায় অবহেলা দেখিয়েছে। জানুয়ারি থেকে নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব ছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। তখন অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষা করতে দেওয়া হতো না। অনেক লেখালেখি ও সমালোচনার মুখে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষায় যুক্ত করা হয়। এখন ৮৩টি কেন্দ্রে সুযোগ থাকলেও পরীক্ষা বাড়ছে না।

অনেক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হচ্ছে না। যেমন রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারে দৈনিক তিন হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে এক হাজারের কিছু বেশি।

হঠাৎ শনাক্ত হার বৃদ্ধি

ঈদের সময় পরীক্ষা কমে যাওয়ার পাশাপাশি রোগী শনাক্তের হারের ধারাবাহিকতার ঘাটতি দেখা গেছে। এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। গত দুই মাসে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের কাছাকাছি। ১ ও ২ আগস্ট শনাক্তের হার ছিল যথাক্রমে ২৫ ও ২৪ শতাংশ। আবার গতকাল ৪ আগস্ট এই হার ছিল ২৫ শতাংশ। রোগী শনাক্তের হারে ধারাবাহিকতা বা সামঞ্জস্য ছিল। অন্য রকম দেখা গেছে ৩ আগস্টের ফলাফলে।

৩ আগস্ট ৪ হাজার ২৪৯টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৩৫৬টি নমুনায়। অর্থাৎ শনাক্তের হার ছিল প্রায় ৩২ শতাংশ। এই হার ছিল এযাবৎকালের সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি আগের ও পরের পরীক্ষায় রোগী শনাক্তের হারের সঙ্গে এই হার ছিল সংগতিহীন। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, যাঁদের করোনার লক্ষণ-উপসর্গ ছিল, তাঁরাই পরীক্ষা করিয়েছিলেন বলে শনাক্তের হার বেশি দেখা গেছে।

তবে সরকারি এই তথ্য থেকে সংক্রমণ পরিস্থিতি বোঝার কোনো উপায় নেই বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা নমুনা পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁদের কিছু মানুষের আক্রান্তের তথ্য জানা যাচ্ছে। এই তথ্য থেকে সারা দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি জানা যাচ্ছে না, জানা যাবে না।

পরীক্ষার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি মানুষকে সঠিক তথ্য দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘দেশে সংক্রমণ কম, আমরা করোনা জয় করেছি—এসব কথা বললে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। মানুষ নিয়ম মানবে না, মাস্ক পরবে না। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন থেকে যাবে।’

এক দিনে ৫০ জনের মৃত্যু

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য তুলে ধরেন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় আগের নমুনাসহ পরীক্ষা করা হয়েছে ৭ হাজার ৭১২টি নমুনা। এতে ১ হাজার ৯১৮ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০ জনের করোনা শনাক্ত হলো। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৫০ জন। এ নিয়ে করোনায় মোট মৃত্যু ৩ হাজার ২৩৪ জনের।

সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়