করোনায় কমেনি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভূমি দখল, নিপীড়ন

করোনা মহামারির মধ্যে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ওপর নানা নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। কমেনি নারীর ওপর নিগ্রহ। এর সঙ্গে ভূমি দখলের ঘটনাও ঘটেছে।

এসব তথ্য মিলেছে ‘আ র‍্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট: দ্য ইমপ্যাক্ট অব কোভিড-১৯ অন দ্য ইনডিজিনাস অ্যান্ড ট্রাইব্যাল পিপলস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে। আজ বুধবার সন্ধ্যায় এক ভার্চ্যুয়াল সভায় এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হবে।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ থেকে জুন—এই চার মাসে অন্তত তিনটি ধর্ষণের ধটনা ঘটেছে। এ সময় থেমে ছিল না ভূমি দখল। ছয় হাজার একরেরও বেশি ভূমি দখল হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক ব্যক্তি। জোর করে ধরপাকড়, বাড়িতে হামলাসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৬৫টি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম আজ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়নের বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে একটি থিমেটিক কমিটি আছে। এই কমিটি বিষয়গুলো তুলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।

ইউরোপীয় কমিশন ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় তৈরি প্রতিবেদনটি সম্পাদনা করেছেন কাপেংয়ের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা। তিনি বলেন, দেশের ১৪টি জেলা ১৬টি জাতিসত্তার মানুষের কাছে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্ধারিত প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে এ তথ্য নেওয়া হয়। প্রত্যক্ষভাবে তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

এ প্রতিবেদনের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর কোভিড–১৯–এর প্রভাব। এরই মধ্যে একটি অংশে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত যে তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর দুটিই ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। তিনটি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত ধর্ষণকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের।

৪ মার্চ খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার একটি গ্রামে এক মারমা কিশোরী (১৫) ধর্ষণের শিকার হয়। পরদিন সন্ধ্যায় মেয়েটির মা স্থানীয় যুবক আবদুল মান্নান ওরফে মানুর বিরুদ্ধে মামলা করেন।

১৪ মে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানা এলাকায় এক রাখাইন কিশোরী (১৫) ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় পুলিশ আল আমিন (২৩) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে।

৮ মার্চ রাজশাহীর তানোর উপজেলায় ঘরে ঢুকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নারীকে ধর্ষণ করেন এক যুবক। পুলিশ সূত্র জানায়, পরে ধর্ষণের অভিযোগে হাসান আলী নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে জেলা হাজতে পাঠানো হয়। করোনাকালে ধর্ষণসহ ধর্ষণের চেষ্টা, শারীরিক নিগ্রহ, ভূমির কারণে হামলার ঘটনা ঘটে ১৪টি।

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনী ত্রিপুরা বলেন, ‘এই মহামারির মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীর ওপর নিগ্রহ কমেনি। বরং কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়েছে।’

নারীর প্রতি এই সহিংসতার পাশাপাশি পাহাড় ও সমতলে ৬৫টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে চার মাসে। এর মধ্যে ৬৩টিই ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। নির্বিচার আটক, শারীরিক নির্যাতন, নিগ্রহ—এসব রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন নতুন কোনো ঘটনা নয় বলে মন্তব্য করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য চিং কিউ রোয়াজা। আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নানামুখী মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভূমি দখল এখানে চলে আসছে। কোভিড–১৯–এর সময় এটি বেড়ে গেলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত। আর এ ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে নিরপেক্ষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

চিং কিউ রোয়াজ যে ভূমি দখলের কথা উল্লেখ করলেন কাপেংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার মাসে ৬ হাজার ৫০৪ একর ভূমি জবরদখল হয়েছে বা হওয়ার পথে রয়েছে।

পল্লব চাকমা বলছিলেন, এর বেশির ভাগই পার্বত্য এলাকার। আর কোভিডকালে এর পরিমাণ যেন বেড়ে গেছে।

তবে শুধু পাহাড়ে নয়, সমতলেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে ঘটেছে সহিংসতাও।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের ফুলকুঁড়ি মোড়ে ২৫ জুন সকালে বঙ্গপাল সর্দার (৪৮) নামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক নেতা দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন। তাঁকে কাঠের চেলা দিয়ে বেদম পিটিয়ে আহত করে ওই দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে হামলাকারীরা একটি মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যায়।

হামলার শিকার বঙ্গপাল সর্দার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন লাহান্তি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার রক্ষা ও তাঁদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর রাজশাহী এলাকায় কাজ করে আসছে এই ফাউন্ডেশন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের টংপাড়ায় খাসজমিতে শতাধিক বছর ধরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন বসবাস করে আসছে। পাশের একটি পুকুরও দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করে আসছে তারা। কিন্তু একটি জালিয়াত চক্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজনকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করতে চায়। এর অংশ হিসেবে এই হামলা হয়েছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ।

এ ঘটনার পর স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী–পুরুষেরা রাজশাহী–নাচোল সড়ক অবরোধ করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমি দখলের এসব ঘটনা ঘটেনি, এটা হয়তো ঠিক না। আবার হয়েছে, তা–ও বলব না। আসলে আমার কাছে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কিছু বলেনি।’ তবে ভূমি দখলের বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।