'বছর বছর ঘরবাড়ি ভাঙলে কেমঠাই ঠিক করব'

জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হয়েছে। ছবিটি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার উলিয়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি
জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির ফের অবনতি হয়েছে। ছবিটি জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার উলিয়া এলাকা থেকে তোলা। ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

সেফালী বেগমের একটি মাত্র ঘর। সন্তান নিয়ে এই ঘরেই থাকেন। বান বছর বছর তাঁর ঘরটি ভেঙে দিয়ে যায়। যাতে আর না ভাঙে, তাই সুদে টাকা নিয়ে গত বছর ঘরের পিড়ে পাকা করেছিলেন। কিন্তু এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পাকা পিড়াসহ ঘরের মাটিও বানের তোড়ে ভেসে গেছে। ভাঙা ঘর কীভাবে মেরামত করবেন, তার কোনো উপায় নেই। স্বামী কৃষিকাজ করেন। দুই মাস থেকে মাঠে পানি থাকায় সব কাজকর্ম বন্ধ। কোথায় পাবেন ঘর মেরামতের টাকা। সেফালী বেগমের মতো অবস্থা এখন বানভাসি প্রায় পরিবারের। বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

বন্যাদুর্গত জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার পূর্ব বলিয়াদহ গ্রামে সেফালী বেগমের সঙ্গে কথা হয় বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। তাঁর সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় এই গ্রামের অন্য বানভাসিরা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। সবাই বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

সেফালী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বানে আমগরে শেষ করে দিয়েছে। মরার বান কোঠা থেকে আহে। বছর বছর আমগরে কি দেখছে। বান গরিবগরেই দেখে। বছর বছর ঘরবাড়ি ভাঙলে, কেমঠাই ঠিক করব। কোঠাও কামকাজ নাই। পুলার বাপ বসনে। কোঠাই কাম করবে। সব হানেই পানি। খাউনের টাহাই নাই। ঘরবাড়ি কেমঠাই ঠিক করব। গত বছরও সুতে সব ভাসায় নিল। সুদে টাহা নিয়ে কোনোরকম ঠিকঠাক করছিলাম। আর ঠিকঠাক করার উপায় নাই।’

পূর্ব বলিয়াদহ গ্রামটির পূর্ব পাশ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে গেছে। পশ্চিম পাশ দিয়ে একটি পাকা সড়ক। এই সড়কটি দেখেই বন্যার ভয়াবহতা বোঝা যায়। কিছুদূর পরপর সড়কটি লন্ডভল্ড। কয়েকটি স্থানে বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সড়কের দুপাশে এখনো গলাসমান পানি। এই গ্রামের বেশির ভাগ বানভাসির ঘর কোনো না কোনো ক্ষতি হয়েছে। কারও ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে আবার কারও ঘরের পিড়া ভেঙে গেছে। অনেকের আবার ঘরের ভেতরের মাটি পর্যন্ত ভেসে গেছে। এই গ্রামের সঙ্গে সড়কপথের সব যোগাযোগ এখন বিছিন্ন হয়ে গেছে। পায়ে হেঁটে চলাচল ছাড়া উপায় নেই। এই গ্রামের মানুষ এখন চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে।

বেলী বেগমের দুঃখটা একটু অন্য রকম। তাঁর একমাত্র ছেলে ঢাকায় থাকে। তাঁদের কোনো খোঁজখবর রাখে না। তার মধ্যে সম্প্রতি তাঁর স্বামীও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফলে রোজগার করার কেউ নেই। দুই মেয়ে আর স্বামীকে তাঁরই দেখতে হয়। মানুষের বাড়িতে কাজকাম করে সংসার চলে। তিনি বলেন, ‘বাপু পুলাডা, কোন দিনও খুঁজ লই না। বউ নিয়েই থাকে। ওপর দিয়ে এই যে বান গেল। কত কষ্ট করলাম। এডা ঘরের মধ্যেই থাকি। বানের পানিতে ঘরটার হাল নাই। খাউনের টাহাই নাই, ঠিক করুম কেমনে।’

সেফালী ও বেলী বেগমের মতো করুণ অবস্থা এই গ্রামের জমিলা বেগমেরও। তাঁর ঘরও ভেঙে গেছে। তিনি এখন মেয়ের বাড়িতে থাকেন। এমন অবস্থা রফিকুল ইসলাম, সুরবান, জাহানারা, কালুনি বেগম, বেলী সুন্দরী, আলম মিয়াসহ বহু মানুষের।

আলম মিয়ার একটি ঘরের মাটিসহ অর্ধেক ভেসে গেছে। তিনি বলেন, ‘বানের সুত এন্দেই যাই। জীবনটা শেষ করে দিল। নিজেরাই চলতে পারি না। তার মধ্যে ঘরবাড়ি ঠিকঠাক করুম কেমনে। হারা বন্যায় ১০ কেজি চাল পায়ছি। আর কোডাই পায়নি। আমগরে দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝে না।’