আহমদ রফিকের রবীন্দ্রযাপন

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক

কবি, প্রাবন্ধিক-গবেষক, ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক আগামী মাসে ৯০ পেরিয়ে ৯১ বছরে পদার্পণ করবেন। নানা পরিচয় তাঁর, নানা ভূষণ; ‘রবীন্দ্র-গবেষক’ও তেমনই একটি। তবে অন্য যে কারোর চেয়ে একটু ব্যতিক্রম বটে। বিচিত্র রবীন্দ্র-বিষয়ে ২০টির বেশি বইয়ের এই অনন্য লেখকের হাতে এখন লেখা হয়ে চলেছে রবীন্দ্রজীবনী।

বাংলা একাডেমি ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করে রবীন্দ্রবিষয়ক তাঁর প্রথম বই আরেক কালান্তরে। এরপর গত ৪৩ বছরে একে একে লিখেছেন ছোটগল্প: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প, রবীন্দ্রভুবনে পতিসর, রবীন্দ্রসাহিত্যের নায়িকারা: দ্রোহে ও সমর্পণে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা: একটি অধ্যায়, রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম: কৃষি ও কৃষক, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ: এই বাংলায়, রবি বাউল ও তাঁর বিচিত্র ভাবনা, রবীন্দ্রচর্চা: বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কার, নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ, শিশুদের রবীন্দ্রনাথ, কিশোরদের রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রকেন্দ্রিক তাঁর সমস্ত রচনা দুই খণ্ডে সংকলিত হয়েছে নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ শিরোনামে।

আহমদ রফিকের রবীন্দ্রচর্চা কেবল গ্রন্থগত পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি ‘রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র ট্রাস্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রচর্চা পত্রিকার সম্পাদক। নওগাঁর পতিসরে রবীন্দ্র-স্মৃতিস্থান পুনরুদ্ধার-প্রয়াসের এই পুরোধা একজীবনের রবীন্দ্রচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি (১৯৯৫) আর বাংলা একাডেমির ‘রবীন্দ্র পুরস্কারে’ (২০১১) ভূষিত হন।

জীবনজুড়ে এমন নিমগ্ন রবীন্দ্রযাপনের পরও তিনি তৃপ্ত নন। অশেষ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এখনো বিশেষ অন্বেষা ও আবিষ্কারে উন্মুখ তিনি। এরই প্রকাশ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রবীন্দ্রজীবন-এর বিশাল কর্মযজ্ঞ।

মূলত সার্ধশত রবীন্দ্রজন্মবর্ষের প্রাক্কালে বাংলা একাডেমি রবীন্দ্রজীবন ও সৃষ্টিলগ্ন বাংলাদেশ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রজীবনী প্রণয়ন ও প্রকাশের পরিকল্পনা হাতে নেয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী এবং প্রশান্তকুমার পালের রবীজীবনীর মতো মহার্ঘ্য কৃতির পর নতুন তাৎপর্যের রবীন্দ্রজীবনীকার হিসেবে নির্বাচন করা হয় নিষ্ঠাবান রবীন্দ্রসাধক আবদুশ শাকুরকে। এই ইতিহাস উঠে এসেছে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক (বর্তমান সভাপতি) শামসুজ্জামান খানের প্রাক্‌কথন-এ:

‘আবদুশ শাকুর বিপুল শ্রম ও গভীর নিষ্ঠায় রবীন্দ্রজীবন-এর প্রথম দুটি খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের জীবনের ৩০ বছর পর্যন্ত তাঁর সৃজন ও জীবনের অনুপুঙ্খ ভাষ্য রচনা করেন। কিন্তু একান্ত পরিতাপের বিষয় আকস্মিকভাবে আবদুশ শাকুর রবীন্দ্র-জীবনের দুটি খণ্ড সমাপ্ত করার পরই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে রবীন্দ্রজীবনের বাকি অংশ রচনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন খ্যাতনামা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ আহমদ রফিক।’

আবদুশ শাকুর পরিকল্পনা করেছিলেন নতুন রবীন্দ্রজীবনী হবে চার খণ্ডের। তবে আহমদ রফিকের মতে পাঁচ খণ্ড ব্যতীত রবিজীবনের বর্ণাঢ্য-বর্ণিল উত্তরপর্বের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হওয়ার নয়।

অতঃপর ৯০ ছুঁই ছুঁই বয়সে দিনরাতের ক্লান্তি ও ক্ষান্তিহীন শ্রম আর সাধনার ফসল হিসেবে ২০১৬ সালে রবীন্দ্রজীবন, তৃতীয় খণ্ড এবং ২০১৯-এ রবীন্দ্রজীবন, চতুর্থ খণ্ড বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হলো। এই দুই খণ্ডে ১৮৯১-১৯২৬, অর্থাৎ ৩১ থেকে ৬৫ বছরের রবীন্দ্রজীবন ধারণ করা হয়েছে; যার মধ্যে আছে যুবক থেকে পরিণত কবি, নোবেলপ্রাপ্তি আর দ্বন্দ্বমুখর পৃথিবীর আলোছায়ার ছাপ।

আহমদ রফিক জীবনী রচনায় তথ্যের অনুগমনকেই ধ্রুব জ্ঞান করেন না, মিতকথার বিশ্লেষণকেও সঙ্গী করে নেন। পূর্বতন জীবনীকারদের পরিবেশনাকে মূল্য দেওয়ার পাশাপাশি পুনর্বিচার, সংযোজন ও যথাযথ ব্যাখ্যা-তৎপর।

চতুর্থ খণ্ডের ‘প্রবেশক’-এ বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী সংগতই বলেছেন—

‘যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা চিনতে চাই, সে রবীন্দ্রনাথের জীবনতথ্যই তিনি তুলে ধরেছেন। তথ্যবিন্যাসে ও জীবনকর্মমূল্যায়নে তিনি স্বকীয় ও স্বতন্ত্র।’

কিছু নমুনা-সমাবেশে উপলব্ধ হবে আহমদ রফিকের রবীন্দ্রজীবনীর বহুকৌণিক বিভা।

১৮৯১ সালের ভুক্তিতে বলেছেন—

‘সাহিত্য অঙ্গনে এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সাপ্তাহিক হিতবাদীর প্রকাশ। হিতবাদীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের কলমে প্রকৃত আধুনিক ছোটগল্পের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক। কিন্তু হিতবাদীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রবীন্দ্রনাথের কাছে হালকা রসাত্মক গল্পের জন্য কর্তৃপক্ষের দাবি বিচ্ছেদের কারণ বলে মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ফরমাইশি লেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। এটা তাঁর স্বভাব-বিরোধী।’

১৯১৩ সালের ভুক্তি প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার। এই বছর কবির নোবেলপ্রাপ্তিই এমন ব্যাপ্তির কারণ নয় মোটেও। আহমদ রফিক পটভূমি, প্রাপ্তি ও প্রতিক্রিয়ার ত্রিবেণীতে রবিজীবনের এক বিশেষ পর্যায়কে মালাবদ্ধ করেছেন, যেখানে মার্কিন পত্রিকার ভয়ংকর বর্ণবাদী মন্তব্য ‘একজন অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হলো’র পাশাপাশি বাদ যায়নি স্বদেশের নোবেল-উত্তর সংবর্ধনা সভা পণ্ডের খবরও। এর পরপর জীবনীকার ১৯১৩ সালের ভুক্তিতে ‘শেষের মধুর’র মতো যেন বলেন—

‘উত্ত্যক্ত মন শান্ত করতে তাঁর বরাবরের চিকিৎসা গান রচনায় মন দেন। শান্তিনিকেতনে বসে এ সময় (নভেম্বর ৩০) লেখেন গুটিকয়েক গান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য “আমার সকল কাঁটা ধন্য করে”।’

১৯২৬ সাল, অর্থাৎ বছর পঁয়ষট্টির ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের অসাধারণ এমন উৎকলন আহমদ রফিকের রবীন্দ্রজীবনীকে তথ্যের শুষ্ক ঘেরাটোপ থেকে প্রাণপূর্ণ আখ্যানে উত্তীর্ণ করে যেন—

‘কায়রোর বিখ্যাত জাদুঘর-পাঠাগার এবং মিসরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনাদি (পিরামিড, মমি, বিচিত্র শিল্পকলা) দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য: “এইসব কীর্তি দেখে মনে মনে ভাবি যে, বাইরে মানুষ সাড়ে তিন হাত কিন্তু ভিতরে সে কত প্রকাণ্ড”।’

চক্ষুপীড়াসহ নানা স্বাস্থ্যগত জটিলতা এখন ঘিরে ধরেছে আহমদ রফিককে। করোনার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও ব্যাহত। রবীন্দ্রজীবন-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন—

‘প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনের দিন-তারিখ খুঁটিনাটির ওপর নির্ভর করে, বিশেষত ঠাকুরবাড়ির “ক্যাশবহি”র ফারসি প্রভাবিত বাংলায় লেখা তথ্যনির্ভর করে অসাধারণ শ্রমে রবিজীবনী রচনার কাজ ৯ খণ্ডে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যদিও তা অসম্পূর্ণ। এ কাজ সম্পূর্ণ করার অবকাশ জীবন তাকে দেয়নি।’

বাংলা একাডেমির রবীন্দ্রজীবন-এর ৫ম খণ্ডের কাজ করছেন আহমদ রফিক। শারীরিক দুর্দৈবে কাজটি সম্পন্ন করা কঠিন হলেও তাঁর অন্তরের আকুল আকাঙ্ক্ষা-কাজটির যথাযথ ইতি টানার কাম্য অবকাশ জীবন যেন তাঁকে দেয়।

আর আজ বাইশে শ্রাবণ, রবীন্দ্র-প্রয়াণবার্ষিকীতে আহমদ রফিকের সঙ্গে এ প্রত্যাশা তো আমাদের সবারই।