পদ্মার ঢেউয়ে মানুষের ঘরে ঘরে কান্না

পদ্মার পানি এখন দোহারের চর কুসুমহাটি গ্রামের হারেজ আলীর ঘর-বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এক মাস আগে বাড়ির উঠোনে বুকসমান পানি জমে। ঘরের ভেতর জমে হাঁটুপানি। ঘরদুয়ারে থাকতে না পেরে হারেজ আলী স্ত্রী ও চার সন্তানকে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে যায় বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ সব মালামাল।

পদ্মারপারের মানুষ বলে হারেজ আলীর জীবন বড় কষ্টের। ৫৫ বছর বয়সে তিন–তিনবার পদ্মায় তাঁর ঘর-বাড়ি বিলীন হয়েছে। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। পদ্মা যখন তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নেয়, তখন আবার তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়ান। কারণ, পদ্মার সর্বগ্রাসী রূপের সঙ্গে তাঁর জানাশোনা অনেক দিনের। পদ্মায় মাছ ধরেই সংসার চালান তিনি।

দোহারের চর কুসুমহাটি গ্রামের হারেজ আলীর পরিবার এক মাস ধরে ঘরছাড়া। হারেজ আলী এখন থাকেন নৌকায়। ছবি: আসাদুজ্জামান
দোহারের চর কুসুমহাটি গ্রামের হারেজ আলীর পরিবার এক মাস ধরে ঘরছাড়া। হারেজ আলী এখন থাকেন নৌকায়। ছবি: আসাদুজ্জামান

বন্যায় সবাই বাড়ি ছেড়ে গেলেও হারেজ আলী বাড়ি ছেড়ে যাননি। ঘরের সামনে অথই পানির ওপর নৌকায় থাকেন। ঝড়-বৃষ্টি–রোদ মাথায় নিয়ে এক মাস ধরে সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি। অভাব–অনটনের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তাঁর। টিনের ঘরের নিচের মাটি বন্যার পানিতে মিশে গেছে। নষ্ট হয়েছে বাথরুম। এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু হারেজ আলীর মনে সুখ নেই। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর কীভাবে আবার ঠিক করবেন? ঘরদুয়ার ঠিক করতে কমসে–কম ৫০ হাজার টাকা প্রয়োজন। এই টাকা তিনি কোত্থেকে জোগাড় করবেন? বন্যায় হারেজ আলী সরকারি সহযোগিতা বলতে পেয়েছেন ১০ কেজি চাল। তাও ১৫ দিন আগে। আর কোনো সহযোগিতা পাবেন কি না জানা নেই তাঁর।

হারেজ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মাপারের এই চর কুসুমহাটি গ্রামে আমার জন্ম। তিনবার করে আমার ঘর বিলীন হয়েছে। এইবারের মতো এত বড় বন্যা হয়েছিল, সেই ’৯৮ সালে। কিন্তু আমাদের দেখার কেউ নেই। মেম্বার যারা, যাদের বড় বড় বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, তাদের সাহায্য দেয়। সরকারি খাতায় তাদের নাম আছে। আমাগো নেই। যারা বড়লোক, তারাও সহযোগিতা পাচ্ছে।’

হারেজ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, মুহূর্তে মুহূর্তে পদ্মার পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে উঠোনে। ঘরের দরজায় তালা মারা। মানুষ না থাকলেও আছে কিছু কবুতর। এই কবুতরগুলোকে রোজ খাবার দেন হারেজ আলী।

ঘরগুলো পদ্মায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঘরগুলো পদ্মায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ছবি: আসাদুজ্জামান

বন্যার পানিতে কেবল একা হারেজ আলীর জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে, তা নয়, হারেজ আলীর মতো আরও তিন হাজার পরিবার বন্যার পানিতে ভাসছে। দোহারের মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চর কুসুমহাটিসহ ওই ইউনিয়নের ১১টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় এক মাস হলো তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী। গত মঙ্গলবার বন্যায় সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মোহাম্মাদপুর ইউনিয়নের চর কুসুমহাটি, চর পুরুলিয়া ও চর মোহাম্মাদপুর ঘুরে দেখা গেল, পদ্মাপারের বাসিন্দা হারেজ আলীর মতো আরও বহু মানুষ ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। পানির তলে ঘরদুয়ার। উঠোনে দেখা দিয়েছে সবুজ শেওলা। গাছপালা মরে গেছে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট সব ভেঙে গেছে। যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে যায়নি, তারা সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। বিশেষ করে যেসব পরিবারে শিশুরা আছে, তারা আছে বড় আতঙ্কে। সারাক্ষণ ভয় তাড়া করে ফিরছে। করোনার এই সময়ে স্কুল বন্ধ থাকলেও ওই সব এলাকার শিক্ষার্থীর বাড়িতে বসে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব শিক্ষার্থী পরিবারের সঙ্গে নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে, তারা আছে দুশ্চিন্তায়। কবে নাগাদ বন্যার পানি যাবে, কবে নাগাদ তার পরিবার বাড়িঘর ঠিক করবে, এমন হরেক রকমের দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছে তাদের।

দোহারের পদ্মারপারের এসব মানুষের বেশির ভাগ দিন আনে দিন খায়। ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। বেশির ভাগ মানুষ পদ্মায় মাছ ধরে সংসার চালায়। বর্ষার সময় পদ্মায় পানি বেড়ে যায়, ফলে মাছও ধরা পড়ে কম। আয় কমে যায়। এমন সময় এই বন্যা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।

দোহার উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় পদ্মার তীরবর্তী কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করেছি। করোনার সময়ে চাল, ডাল, তেল দেওয়া হয়েছে অসহায় মানুষকে। এখন বন্যার্ত মানুষকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমাদের এলাকার সাংসদ সালমান এফ রহমানের পক্ষ থেকেও অসহায় মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।

পদ্মার ঢেউ ঘরে আছড়ে পড়ছে
চর কুসুমহাটি গ্রামের শেখ মান্নানের ঘর থেকে দেখা যায় মৈনটঘাট, যা মিনি কক্সবাজার নামে পরিচিত। যেখানে বছরের বিভিন্ন সময় শত শত পর্যটকের পা পড়ে। মান্নান রোজ দেখেন, পদ্মার পাড়ে মানুষ মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের কথা ভেবে মাঝেমধ্যে মান্নানের খুব খারাপ লাগে। রাতদিন পড়ে থাকেন পদ্মায়। যেদিন তাঁর জালে বেশি মাছ ধরা পড়ে, সেদিন মান্নানের মন খুশিতে ভরে ওঠে। ছেলেমেয়ের মুখে একটু মাংসের টুকরা তুলে দিতে পারবেন।

মান্নানের স্ত্রীর নাম আকলিমা। এই দম্পতির তিন মেয়ে, এক ছেলে। মেজ মেয়ে পাখির বয়স ১০ বছর। সে প্রতিবন্ধী। ঠিকমতো হাঁটতে পারে না, কথাও বলতে পারে না। বন্যায় এই মেয়েটিকে নিয়ে বড় বিপদের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের। কারণ, মেয়েটির অসুখ। প্রায় সময় জ্বর আসে। এই বন্যায় নৌকা ছাড়া চলার কোনো উপায় নেই। এর মধ্যে এক দিন পরপর পাখিকে নিয়ে যেতে হয় চিকিৎসকের কাছে।

মান্নানের বাথরুমের টিন পদ্মায় তলিয়ে গেছে, গোয়ালঘরে মাটি নেই। রোজ পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেখানে। মান্নানের বাড়ির উঠানে দাঁড়ালে পদ্মার গর্জন ভালোভাবে টের পাওয়া যায়। বন্যার পানিতে ভাসছে মান্নানের টিউবওয়েল, ঘরের মেঝের মাটিগুলো বন্যার পানির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। টিনের ঘরের নিচ দিয়ে পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সেখানে। এমন একখানা ঘরে লোহার একখানা খাটে মান্নান তাঁর পরিবার নিয়ে বেঁচে আছেন। সরকারি সহযোগিতা বলতে বন্যায় মান্নানের পরিবার ১০ কেজি চাল পেয়েছে। কিন্তু অভাব মান্নানের পরিবারকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মান্নানের একটা ছোট গরু ছিল, বন্যায় ঘরবাড়ি সব তলিয়ে যাওয়ায় তা এলাকার উঁচু স্থানে রেখে এসেছেন। ঘরে প্রতিবন্ধী মেয়ে থাকায় আর ঘর ছেড়ে তিনি কোথাও যাননি। তবে এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানি নেমেছে। ঘরদুয়ার কীভাবে ঠিক করবেন, তা নিয়ে মান্নানের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা হলে তিনি আবার ঘরদুয়ার ঠিক করে কোনোমতে জীবন চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু এত টাকা তিনি কোত্থেকে জোগাড় করবেন? জীবনভর মান্নান পদ্মায় মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু শেখেননি যে!

ফজরের আজানের সময় রোজ নৌকা নিয়ে পদ্মায় চলে যান। মাছ ধরে তা মৈনটঘাটে বিক্রি করেন মান্নান। তবে করোনায় বেচাকেনা একেবারে কমে গেছে। মাছের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এর মধ্যে বন্যা হানা দিয়েছে। আয় কমে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে বড়ই বিপাকে আছেন মান্নান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাগো ঘরে আষাঢ় মাসে পানি এসেছে। দুই মাস ধরে আমরা তলানো। এইবারের বন্যার মতো বন্যা হয়েছিল ’৯৮ সালে, ২০০৪ সালে। বন্যায় ঘরে মাটি নেই। এই মাটি-মুটি ওঠাতে গেলে টেহাপয়সা দরকার। কিন্তু এই টেহাপয়সা এখন কোথায়ে পাব? বড় কষ্টে যাচ্ছে। পোলাপানের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। কামাই-রুজি কমে গেছে। কয়টা মাছ-মুছ ধরে পোলাপান নিয়ে বেঁচে ছিলাম। কিন্তু করোনায় মাছ-মুছের দাম নেই। কেমনে সংসার চালামু, বুঝতে পারছি না। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা সেভাবে পাচ্ছি না।’

চর পুরুলিয়া গ্রামের সালেহার কোনো সন্তান নেই। বন্যায় তলিয়ে গেছে তাঁর ঘর। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চরম অর্থকষ্টে জীবন পার করছেন। ছবি: আসাদুজ্জামান
চর পুরুলিয়া গ্রামের সালেহার কোনো সন্তান নেই। বন্যায় তলিয়ে গেছে তাঁর ঘর। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে চরম অর্থকষ্টে জীবন পার করছেন। ছবি: আসাদুজ্জামান

বৃদ্ধ সালেহার অনেক কষ্ট
চর পুরুলিয়া গ্রামের সালেহা বেগমের বয়স ৭৫ বছর। তাঁর স্বামীর নাম শেখ লাল মিয়া। তাঁর বয়স ৮৪ বছর। সালেহা ও লাল মিয়ার সংসারজীবন ৫৫ বছরের। তবে সালেহা ও লাল মিয়া নিঃসন্তান। বয়সজনিত নানা জটিলতায় ভুগছেন দুজনেই। তবে লাল মিয়া ঘর থেকে বের হতে পারেন না। সালেহা বেগমই তাঁকে দেখাশোনা করেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে তাঁর ঘর। স্বামীকে নিয়ে বড় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন সালেহা।

সালেহার আয়ে চলে তাঁর সংসার। অন্য সময়ে পরের বাড়িতে কাজ করে যা পেতেন, তা দিয়ে কোনো মতে খেয়েপরে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বন্যায় তাঁর কাজ কেড়ে নিয়েছে। কারণ, তাঁর গ্রামের প্রত্যেক মানুষের ঘরে পানি। ঘর ছেড়ে সব অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেকেরই অভাব। সবাই যার যার সংসার, যার যার ছেলেমেয়ে বাঁচাতে ব্যস্ত। এমন সময়ে সালেহা পড়েছেন অস্তিত্ব সংকটে। বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে পানির ভেতর দিনের পর দিন পার করছেন। এর মধ্যে খাবারের চিন্তা তাঁকে পাগল করে তুলেছে। দিন দশেক আগে সরকার থেকে কয়েক কেজি চাল পেয়েছেন সালেহা। সেই চালও ফুরিয়ে গেছে। এখন অন্যের কাছ থেকে চাল ধার করে বেঁচে আছেন সালেহা। ঈদের সময় কোরবানির কিছু মাংস পেয়েছেন। যতটুকু পারছেন, অসুস্থ স্বামীকে খাওয়াচ্ছেন, নিজে খাচ্ছেন।

ঘরে-বাইরে পানি দেখে সালেহার মনে পড়ে ’৯৮ সালে বন্যার কথা। তখন বয়স কিছুটা কম ছিল। কষ্ট করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এখন কষ্ট করতে পারেন না। বেশি হাঁটাচলা করলে বুক ধড়পড় করে। মনে হয় এই বুঝি জান বেরিয়ে যায়। সালেহা যখন নিজের কষ্টের কথা শোনাচ্ছিলেন, তখন তাঁর চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। এলাকায় তাঁর মতো দুঃখী কেউ নেই। বন্যার পানি তাঁর দুঃখকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্যার পানি কিছুটা কমলেও এখনো ঘরের সামনে পানি। রাতের বেলা স্বামীর অসুখ যখন বেড়ে যায়, তখন বড় ভয় হয় তাঁর। স্বামীর জন্য যত টাকার ওষুধ দরকার হয়, সেই টাকা তিনি জোগাড় করতে পারেন না। যত টাকা জোগাড় করতে পারেন, সেই টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে স্বামীকে খাওয়ান।

সালেহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার যদি একটা ব্যাটা পুত থাকত, তাহলে এত কষ্ট হতো না। বন্যায় তলিয়ে গেছে সব। বুকসমান পানি ভেঙে তবে রাস্তায় আসতে হতো কিছুদিন আগে। তবে পাড়ার মানুষ আসা-যাওয়ার জন্য বাঁশ-খুঁটি পুঁতেছে। তাই এখন চলাফেরা করা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষের বড় অভাব। কাজ-কাম নেই। সরকার যদি সহযোগিতা না করে, তবে আমার মতো মানুষের মুখে দুবেলা ভাত জোটানো বড় কষ্টের।’

ঘরছাড়া আক্কাসের পরিবার
দোহারের চরমাহমুদপুরের আক্কাসের আলীর ঘরে এখন বুকসমান পানি। এক মাস ধরে পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ছে তাঁর ঘরে। ঘরে থাকতে না পেরে আক্কাস আলী স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে এখন অন্যের বাড়িতে উঠেছেন। বন্যার পানি নামার কোনো লক্ষণ নেই। আক্কাসের বাড়ি পদ্মার পাড়ে। পদ্মার পানি কেবল আক্কাসের ঘরে আশ্রয় নেয়নি, তাঁর মতো ওই গ্রামের আরও অন্তত এক শ ঘরে উঠেছে। সবাই এখন ঘরছাড়া। পদ্মার ঢেউয়ে ঢেউয়ে টিনের তৈরি ঘর ভেঙে গেছে। টিনগুলো একে একে চলে যাচ্ছে পদ্মার গহ্বরে। চোখের সামনে অনেক কষ্টে গড়া ঘরগুলো পদ্মায় বিলীন হতে দেখে অভাবী মানুষগুলো পাগলপ্রায়।

ধারদেনা করে কয়েক বছর আগে ঘর তোলেন আক্কাস। এখনো তাঁর ঘরের টিন খুলে না পড়লেও ঘরের নিচের মাটি নেই। মাটি সব পদ্মায় মিশে গেছে। আক্কাসের ঘরের পাশের ঘরের ভেতর গলাসমান পানি। টিনগুলো সব খুলে পড়েছে। এক এক করে টিনগুলো সব তলিয়ে যাচ্ছে পদ্মায়। পদ্মাপারের চর মোহাম্মদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে তীরবর্তী সব বাড়ি। কোনো কোনো ঘরে মাথাসমান পানি, কোনো কোনো ঘরে বুকসমান পানি। এমন ডোবা বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ অন্যত্র চলে গেছে। পদ্মার ঢেউয়ে টিনের বাড়িগুলো সব ভেঙে পড়েছে। মানুষজন বড় অসহায় হয়ে পড়েছে। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া মানুষগুলো বেশির ভাগ হতদরিদ্র। পদ্মায় মাছ ধরে কোনো রকমভাবে বেঁচে আছেন। কিন্তু বন্যায় তাঁদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

আক্কাস আলী পদ্মায় মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বর্ষার এই সময়ে পানি বেড়ে যাওয়ায় মাছ পাচ্ছেন কম। আবার করোনায় এই সময়ে যা মাছ পান, তার দামও সেভাবে পাচ্ছেন না। ফলে যে আয় তা দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তাঁর স্ত্রী ফরিদার কোলে দেড় বছরের সন্তান। ঘর থাকতেও ঘরে যেতে পারছেন না। কবে ঘরে ফিরতে পারবেন, তাও জানেন না আক্কাস আলী।

আক্কাসের স্ত্রী বললেন, ‘এই বন্যায় আমরা বড় বিপদে আছি। সরকার যদি আমাগো না দেখে, আমাগো না সহযোগিতা করে, তাহলে কয়েক দিন পর পোলাপানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে বড় কষ্ট হবে। ধারদেনা করে এক মাস চলেছি, আর চলতে পারছি না।’

বন্যায় সবুজ শেওলা ঘিরে ধরেছে বাড়িঘর। ছবি: আসাদুজ্জামান
বন্যায় সবুজ শেওলা ঘিরে ধরেছে বাড়িঘর। ছবি: আসাদুজ্জামান

আক্কাস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পদ্মাপাড়ের মানুষ। এমন বন্যা বহু বছর দেখিনি। মাছ ধরে, পোলাপান নিয়ে ডাল-ভাত খেয়ে ভালোয় ছিলাম, কিন্তু এক মাস ধরে বন্যা এসে বড় বিপদে পড়ে গেছি। ঘরের ভেতর পদ্মার ঢেউ। আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাইনি। এই সময়ে সরকার যদি আমাগো দিকে হাত বাড়াইয়া দিত, তাহলে আমাগো মতো গরিব মানুষ ভালোভাবে বাঁচতে পারত।’

দোহারের মোহাম্মাদপুর, বিলাসপুর ও সুতারাপাড়া ইউনিয়নের ৫০ হাজার মানুষ বন্যার পানিতে বন্দী। সবাই সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় হতদরিদ্র মানুষেরা সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর বেশির ভাগই যে সরকারি সহযোগিতা পায়নি, সে বিষয়টি উপজেলা পরিষদ কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা অস্বীকার করেননি।

মোহাম্মদপুর ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকার থেকে যে পরিমাণ সহযোগিতা পেয়েছি, তা দিয়ে যতটুকু পেরেছি, মানুষকে সহযোগিতা করেছি। তবে বেশির ভাগ মানুষ সরকারি সহযোগিতা পায়নি। আমার ইউনিয়ন দোহারের মধ্যে সব থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। সরকারি যে পরিমাণ বরাদ্দ পাওয়া দরকার, সেই পরিমাণ বরাদ্দ আমরা পাইনি। বন্যায় ডুবে যাওয়া আমার এলাকার মানুষ বড় বিপদে আছে, বড় কষ্টে জীবন যাপন করছেন।’

একই কথা বলেন দোহার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুজাহার ব্যাপারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু পেরেছি, ততটুকু বন্যার্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করছি। তবে সবাই কিন্তু সরকারি সহযোগিতা পায়নি। বরাদ্দ বেশি পেলে আরও বেশি মানুষকে সহযোগিতা করা সম্ভব হবে।’