সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগাতে হবে

>প্রথম আলো ও ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ বৈঠকটির আয়োজন করে। বিষয় ছিল ‘সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও মৎস্যজীবীদের কল্যাণ’।

নদী, পুকুর ও জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের দরিদ্র মানুষদের বড় অংশ এখনো যথেষ্ট পরিমাণে মাছ পাচ্ছে না। সমুদ্রসীমা জয়ের মাধ্যমে আমরা যে পরিমাণে মাছ আহরণ করছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ মাছ আহরণ করা সম্ভব। এ জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে রাখতে হবে। এতে বঙ্গোপসাগর হবে মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের খনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার ‘সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য, সাগরকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও মৎস্যজীবীদের কল্যাণ’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো ও ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ যৌথভাবে বৈঠকটির আয়োজন করে।

বৈঠকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুস সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘সামুদ্রিক সীমারেখা জয় করায় আমাদের জন্য অবারিত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতেও আমাদের সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। আটটি দেশ মিলে বে অব বেঙ্গল প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ যুক্ত রয়েছে। উপকূলে যেসব যে ভারী ধাতুর দূষণ হয়, তা দূর করতে সহযোগিতা পাবে বাংলাদেশ। বদ্বীপ মহাপরিকল্পনায় কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সামুদ্রিক সম্পদ জরিপ ও সম্পদ আহরণের কথা বলা হয়েছে।’

সাত্তার মণ্ডল আরও বলেন, ‘আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অভ্যন্তরীণ স্বাদুপানির মাছ চাষকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ৬৬ গ্রাম মাছ আমরা খাচ্ছি। কিন্তু তারপরেও গ্রাম ও শহরের গরিবেরা পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ পাচ্ছেন না। ২০০০ সাল থেকে মাছের দাম বাড়েনি। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা কেন তাহলে মাছ উৎপাদনে বিনিয়োগ করবেন, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। রপ্তানি বাজার মাথায় রেখে আমরা সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংগ্রহ করতে পারি।’

মৎস্যসম্পদবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকো–ফিশ–২ প্রকল্পের দলনেতা অধ্যাপক আব্দুল ওহাব বলেন, বাংলাদেশে মাছের মোট উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইলিশ মাছ বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ইলিশ ও জাটকা ধরা নিষিদ্ধের সময়ে জেলেদের সরকার থেকে সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। ফলে জাটকা ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধ ছিল, আর ইলিশের উৎপাদনও বেড়েছে। তবে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের সময়টাকে আরও বৈজ্ঞানিক ও গবেষণানির্ভর তথ্য দিয়ে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গণমাধ্যম দেশের ইলিশ রক্ষায় বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ আহরণ হচ্ছে বছরে ৬ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এটা ১৩ লাখে উন্নীত করা সম্ভব।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ‘ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে ওয়ার্ল্ডফিশের বিজ্ঞাননির্ভর গবেষণা বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু চিংড়িতে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। চিংড়ি চাষের ভাইরাস পরীক্ষার জন্য ৫০০ টাকা খরচ করতে চান না রপ্তানিকারকেরা। কিন্তু ৫০ হাজার টাকা জরিমানা গুনছেন। এসব কারণে চিংড়ি চাষে আমরা এগোতে পারছি না। আমাদের মৎস্যসম্পদের অন্যতম রক্ষাকবচ হচ্ছে সুন্দরবন। সেখানে বেশি মাছ ধরা হচ্ছে, অবৈধ জাল ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, সেখানে মৎস্য অধিদপ্তরের কোনো কার্যক্রম নেই। বন বিভাগ এককভাবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করায় আমরা সেখানকার সম্পদ রক্ষায় সহায়তা দিতে পারছি না।’

ওয়ার্ল্ডফিশের প্রধান কার্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের দলনেতা ইশাম ইয়াসিন মুহাম্মদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদকে প্রভাবিত করছে। এসব প্রভাব মোকাবিলায় গবেষণা ও বিজ্ঞানসম্মত তথ্য–উপাত্তকে ব্যবহার করতে হবে। না হলে বাংলাদেশ সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সুযোগ নষ্ট করবে।

বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমরা মাছ উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ সারিতে আছি। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদকে ঠিকমতো আহরণ করতে পারলে আমরা আরও এগিয়ে যাব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের বলেন, ‘ইলিশ সমুদ্রে যাওয়ার জন্য মেঘনা নদীকে ব্যবহার করে। আমরা নদ–নদীর পানিকে যদি দূষণমুক্ত করতে না পারি, তাহলে মাছ উৎপাদনের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাবে। কীটনাশক ও শিল্পের দূষণ সরাসরি নদী ও জলাশয়ে পড়ছে। তা মাছের শরীরেও থাকছে। ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোর যত্ন না নিলে উৎপাদন আবার কমে আসতে পারে।’

প্রকৃতিবিষয়ক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, ‘আমাদের বঙ্গোপসাগরের অতল অংশ বা সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের সম্পদ রক্ষায় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করলেই হবে না, এটিকে রক্ষায় সরকারের সব সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ, জেলেদের বেশির ভাগই গরিব, তাঁদের সহযোগিতা না দিয়ে সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ করা যাবে না। সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগাতে হলে এককভাবে মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ করলে হবে না। কারণ, এখানে মানুষ ও তার জীবিকা আছে, জীববৈচিত্র্য আছে। ফলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে একযোগে কাজ করতে হবে।’

প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ অতিরিক্ত মাছ আহরণ করায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরাও যাতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে না পড়ি, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মো. এনামুল হক বলেন, ‘আমাদের কিছু কিছু মাছ বঙ্গোপসাগর থেকে অতিরিক্ত আহরণ করা হচ্ছে। যেমন পোয়া, লাক্ষা, চান্দার মতো মাছ বেশি আহরণ করায় এর অস্তিত্ব বিপদে পড়তে পারে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ নিয়ে যেসব গবেষণা বর্তমান সরকারের আমলে শুরু হয়েছে, তা সফলভাবে শেষ হলে দেশের মৎস্যসম্পদে আরও সমৃদ্ধি আসবে।’

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা ইলিশের ক্ষেত্রে যত্ন নিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছি। সমুদ্রের মাছেও আমরা জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে মৎস্য আহরণ করতে পারব। মৎস্যজীবীদের স্বার্থও রক্ষা করতে পারব।’

আলোচনার শুরুতে বক্তারা শোকের মাস আগস্টের কথা তুলে ধরে এই মাসে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।