করোনায় পাহাড়ের পর্যটনে দুঃসময়

চার মাস বন্ধ থাকার পর আবার একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে রাঙামাটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ এই ঝুলন্ত সেতু। ৩ আগস্টের চিত্র।  সুপ্রিয় চাকমা
চার মাস বন্ধ থাকার পর আবার একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে রাঙামাটির অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ এই ঝুলন্ত সেতু। ৩ আগস্টের চিত্র। সুপ্রিয় চাকমা

চারপাশে সুনসান নীরবতা। মাঝেমধ্যে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির। কর্মচারীদের আগের সেই ব্যস্ততা আর নেই। পর্যটক না থাকায় পাখিরাই হয়ে উঠেছে অতিথি। গাছগাছালির সবুজে ভরা ডালে, নিচে বসার চত্বরে—সবখানে তাদের সরব সংগীতের আয়োজন।

সম্প্রতি বান্দরবান জেলা শহরের মেঘলা পর্যটন এলাকায় গিয়ে এই চিত্র দেখা গেল। একসময় পর্যটকদের উপস্থিতিতে মুখর থাকত এলাকাটি। এখন কোনো পর্যটক নেই। কাজ না থাকায় কয়েকজন কর্মচারী চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছিলেন। জেলার অন্যান্য পর্যটন স্পট ঘুরে প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেল।

বান্দরবানের মতো অবস্থা অন্য দুই পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতেও। পাহাড়ঘেরা সবুজ বনভূমি, দেশের সবচেয়ে বড় হ্রদ, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় স্থাপনা, ঝরনার প্রশান্তি—পার্বত্যাঞ্চল বলতেই এসব চোখে ভাসে। ভ্রমণপিয়াসী লোকের পক্ষে এসবের টান উপেক্ষা করা অনেক কঠিন। পাহাড়ের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে লাখো পর্যটক ছুটে আসেন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায়। বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের উপস্থিতিতে একসময় মুখরিত থাকলেও করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটন স্পটগুলো এখন ফাঁকা। এতে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আর ছাঁটাইয়ের কারণে বেকার হয়ে পড়ছেন কর্মীরা। 

করোনা মহামারির কারণে পাহাড়ের পর্যটনশিল্পে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত চার মাসেই ক্ষতি হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। চাকরি হারিয়েছেন প্রায় তিন হাজার কর্মী। এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এখন সীমিত পরিসরে পর্যটনকেন্দ্রগুলো চালুর বিকল্প নেই বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অবশ্য রাঙামাটিতে সীমিত পরিসরে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি দুই জেলায় খোলার প্রক্রিয়া চলছে।

>অলস বসে আছে আড়াই শ হোটেল, মোটেল, রিসোর্টৎ
চাকরি হারিয়েছেন তিন হাজার হোটেল-মোটেল কর্মী

এখানে গড়ে উঠেছে প্রায় আড়াই শ হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। পাহাড়ের তিন জেলায় ভরা মৌসুমে প্রতি মাসে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ পর্যটক ঘুরতে আসেন।

পাহাড়ের পর্যটন ঘিরে বছরে আড়াই শ থেকে তিন শ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পে প্রতিবছর আয়ের পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

তিন জেলার ব্যবসায়ীদের সংগঠন, হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি, ট্যুর অপারেটর সমিতি, লঞ্চ সমিতি এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ওপরের আর্থিক হিসাব পাওয়া গেছে। দেশে ও পাহাড়ে পর্যটনের প্রসার ঘটলেও এই খাত নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কারও কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।

সরেজমিন

সম্প্রতি প্রথম আলোর প্রতিনিধি বান্দরবানের মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রে সরেজমিনে যান। তাঁর উপস্থিতিতে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে সেখানকার কর্মচারীরা। তাঁরা জানালেন, গত মার্চ থেকে চার মাস ধরে মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রের মতো জেলার সব পর্যটন ও হোটেল-মোটেল বন্ধ রয়েছে। নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, রামজাদি, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, বগা লেক, কেওক্রাডং, নাফাকুম—সব জায়গায় এখন শূন্যতা।

খাগড়াছড়ির আলুটিলা গুহা ও মায়াবিনী লেকে স্বাভাবিক সময়ে পর্যটকদের সরব উপস্থিতি ছিল। সম্প্রতি সরেজমিনে সে দৃশ্য আর দেখা যায়নি। খাঁ খাঁ করছে কেন্দ্রগুলো।

রাঙামাটি জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট শুভলং ঝরনা। সারা বছর হাজার হাজার পর্যটক ঝুলন্ত সেতু দেখতে আসতেন। দর্শনার্থীর অভাবে রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ঝুলন্ত সেতুটি হাহাকার করছে।

সম্প্রতি শুভলং ঝরনা, কাপ্তাই হ্রদে গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন স্পট চাং পাং, মেজাং, বড় গাঙ, পেদা টিং টিং ও গাঙ সাবারাং ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পর্যটক না আসায় পর্যটন স্পটগুলো ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়েছে।

করোনার ধাক্কায় ক্ষতি ১০৯ কোটি টাকা

তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ঘুরতে আসেন বান্দরবানে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজারের বেশি পর্যটক বান্দরবানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। এ সময় হোটেল-মোটেল আর রিসোর্টে ঠাঁই পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। বছরের অন্যান্য সময়েও পর্যটকের আনাগোনা থাকে এই জেলায়।

ভরা মৌসুমে করোনার ধাক্কার কারণে বান্দরবানের পর্যটন খাত একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। গত ৫ মাসে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার লোকসান দিতে হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আর রাঙামাটিতে করোনার পর পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২২ কোটি টাকা। খাগড়াছড়িতে এই ক্ষতির পরিমাণ ১২ কোটি টাকা।

পর্যটন ব্যবসায়ীদের ধারণা, করোনার কারণে এই ক্ষতির পরিমাণ সামনে আরও বাড়বে। তাঁরা অনেকে পুঁজি হারিয়ে আবার ব্যবসা দাঁড় করানোর সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এই মুহূর্তে সীমিত পরিসরে পর্যটন চালু করার বিকল্প নেই। 

আবাসিক হোটেল-মোটেল মালিকেরা বলছেন, কোনো আয় নেই। কাজও নেই। তারপরও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে। কিন্তু পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল শত শত পরিবার আয়–রোজগার হারিয়েছে।

বান্দরবান আবাসিক-হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, একজন পর্যটকের পেছনে অন্তত ১১ শ্রেণি–পেশার মানুষের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বান্দরবানের প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখন সব বন্ধ থাকায় প্রায় সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই জেলার সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থান ও আয়বর্ধক এই পর্যটন খাত স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া জরুরি।

খাগড়াছড়ি হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, সারা বছরই পাহাড়ের পর্যটন ব্যবসা জমজমাট থাকে। সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন বৈসাবি আর দুই ঈদে। কিন্তু এবার এই সময়ে করোনার ধাক্কা লেগেছে। 

২০১৭ সালের ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসের ঘটনার পর চরম ক্ষতি মুখে পড়েছিল রাঙামাটির পর্যটনশিল্প। সেই ক্ষতি পুষিয়ে না উঠতেই যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে করোনা।

অর্ধেকের বেশি কর্মী ছাঁটাই 

পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাঙামাটি শহরে ৫৫টি হোটেল-মোটেল এবং সাজেকে ১০৩টি রিসোর্ট-কটেজ রয়েছে। বান্দরবানে হোটেল-মোটেল আছে ৬০টি। খাগড়াছড়িতে আছে ৩০টি। এসব আবাসিক স্থাপনায় ৫ হাজারের বেশি লোক চাকরি করতেন। তাঁদের অধিকাংশই দৈনিক ভিত্তিতে টাকা পেতেন। কিন্তু করোনার ধাক্কায় তাঁদের অর্ধেকের বেশি চাকরি হারিয়েছেন। যাঁরা আছেন, তাঁরা নামমাত্র বেতন পাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তাঁরাও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কায় আছেন।

শুধু হোটেল-মোটেল খাতের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই রকম নয়, আয় হারানোর তালিকায় আছেন ট্যুর গাইড, পর্যটনকেন্দ্রে থাকা দোকানগুলোর মালিক, কাপড় বিক্রেতা, গাড়িচালক ও চালক সহকারী, খাবার দোকানের কর্মচারী, নৌযানচালক-শ্রমিকেরাও।

নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসছেন না বলে জানান রাঙামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া। এতে তাঁদের প্রতি মাসে ৩৫ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। 

রাঙামাটি হোটেল-মোটেল সমিতির সভাপতি মো. মঈন উদ্দিন সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন থেকে পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা আসার পর হোটেল-মোটেল থেকে তিন শতাধিক কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন কিছু ব্যবসায়ী আবাসিক হোটেলগুলোতে মুদিদোকান ও বাসা ভাড়া দেওয়া শুরু করেছেন। বাঁচার জন্য কিছু না কিছু তো করতে হবে। 

কষ্টে আছেন তাঁরাও

আবাসিক হোটেলের কর্মচারী আর নৌযানচালকদের মতো কষ্টে আছেন পর্যটনকেন্দ্রগুলোর দোকানিরাও। পার্বত্যাঞ্চলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে পাহাড়িদের তাঁতে বোনা কাপড় সংগ্রহ করা। তাঁদের তৈরি বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহও করেন পর্যটকেরা। পর্যটক না আসায় বিপদে পড়েছেন এই খাতের লোকজনও।

বান্দরবানের শৈলপ্রপাতের সিয়াম বম কোমর তাঁতের কাপড় ও বাগানের ফল বিক্রি করে সংসার চালান। তিনি বলেন, ‘লোকজন আসে না। কিছু বিক্রি হয় না। জমানো টাকাপয়সাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামনের দিন নিয়ে আমি চিন্তায় আছি।’

কী ভাবছে প্রশাসন 

পার্বত্য জেলার পর্যটন খাতের উদ্যোক্তা, কর্মী, নির্ভরশীল ব্যক্তিরা এখন অসহায় দিন যাপন করছেন। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পর্যটনকেন্দ্রগুলো চালুর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তাঁরা। বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে হলেও যেন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়। প্রশাসনের প্রতি এই আবেদন তাঁদের।

তবে ঈদুল আজহার পর সীমিত পরিসরে পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনের সম্মতি রয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

একই কথা বলেছেন বান্দরবান জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত ডেপুটি কালেক্টর কামরুল ইসলাম। তবে এই ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

তবে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেছেন, খাগড়াছড়িতে প্রতিদিন নতুন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। এই অবস্থায় পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হবে। 

অন্যতম আকর্ষণ পার্বত্যাঞ্চল, চালুর পরামর্শ

দীর্ঘদিন ধরে দেশের পর্যটন খাত নিয়ে লেখালেখি করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দেব। দেশের ও পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন খাত নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। করোনার প্রভাবে পর্যটন খাতের বিপর্যয় ও আর্থিক ক্ষতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন প্রথম আলোর কাছে। এই অবস্থা উত্তরণের জন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো সীমিত পরিসরে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালু করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

সন্তোষ কুমার দেব বলেন, করোনার কারণে পর্যটন খাতে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু করোনার এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে পর্যটন খাতের এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এই খাতসংশ্লিষ্ট প্রায় তিন লাখ মানুষ চাকরি ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। মানুষের জীবিকা রক্ষার অংশ হিসেবে পর্যটনকেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে চালু করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। 

(তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, সাধন বিকাশ চাকমা ও জয়ন্তী দেওয়ান)