১৩ জেলায় মোট মৃত্যুর ৭২ শতাংশ

সারা দেশেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তবে মৃত্যু বেশি হচ্ছে ১৩টি জেলায়। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৭২ শতাংশই এই ১৩টি জেলার বাসিন্দা।

যে জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেসব জেলায় মৃত্যুও বেশি। তবে কয়েকটি জেলায় এর ব্যতিক্রম চিত্রও দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেশে করোনার সংক্রমণে মৃত্যুর এই চিত্র পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গত বৃহস্পতিবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ৩ আগস্ট পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য দেওয়া হয়েছে। ওই সময় পর্যন্ত করোনায় (কোভিড–১৯) আক্রান্ত হয়ে দেশে মোট ৩ হাজার ১১১ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে সরকার। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ২৪২ জনই ১৩টি জেলার বাসিন্দা।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল রাজধানী ঢাকায়। শুরু থেকে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন সবচেয়ে বেশি ঢাকায়, তেমনি মৃত্যুও সবচেয়ে বেশি এখানে। ৩ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় ৯৪৯ জন মারা গেছেন। ঢাকার পর আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে আছে চট্টগ্রাম। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন ২৫২ জন। সংক্রমণের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থানে থাকা কুমিল্লায় মারা গেছেন ১৮১ জন। নারায়ণগঞ্জে ১৪৬ জন, সিলেটে ১১৪ জন ও বগুড়ায় ১১১ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনায়। এসব জেলার প্রতিটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

এর বাইরে গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, খুলনা, নোয়াখালী, বরিশাল ও কক্সবাজারে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এই সাতটি জেলার প্রতিটিতে ৫০ থেকে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সাতটি জেলার মধ্যে চাঁদপুর বাদে বাকি পাঁচটিতেই আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। এর মধ্যে গাজীপুরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজার ছাড়ালেও সে অনুযায়ী মৃত্যু কম হয়েছে। ৩ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে মারা গেছেন ৬১ জন।

এই ১৩ জেলার বাইরে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও ঝিনাইদহে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হলেও মৃত্যু কম। এসব জেলায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। তবে মৃত্যু ৫০–এর নিচে রয়েছে।

আক্রান্তে ইতালিকে ছাড়াল

বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে ৮ মার্চ। এরপর গতকাল পর্যন্ত দেশে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বৈশ্বিক তালিকায় এখন বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৫তম।

ইউরোপের যে দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ ভয়াবহ আকারে দেখা গেছে, তার একটি ইতালি। মোট আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ গতকাল ইতালিকে ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল পর্যন্ত ইতালিতে মোট আক্রান্ত ছিলেন ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮০৩ জন এবং বাংলাদেশে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫১ জন। 

অবশ্য ইতালি সংক্রমণের তিন মাসের মধ্যে সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আর বাংলাদেশে সংক্রমণের পঞ্চম মাস পূর্ণ হবে আগামীকাল। এখনো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তবে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ইতালির চেয়ে বাংলাদেশে এখনো আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর হার কম। ইতালিতে ৩৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় তাঁদের মৃত্যুর হার ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ তথ্য জানান জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজিদ খুরশিদ। তিনি জানান, গত বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ৯৭৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৫১। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৩৯ জন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৩০৬ জনের।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়। ক্রমে মহামারি আকারে সেটা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আট মাস ধরে বিশ্বকে প্রায় স্থবির করে দিয়েছে এই ভাইরাস। এই আট মাসে সারা বিশ্বে করোনায় সাত লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিশ্বের ১৮৮টি দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৭ লাখ ৮ হাজার ৩০১ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

আইইডিসিআরের পরামর্শক ও​ রোগতত্ত্ববিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যেসব এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ বিশেষ করে শহরাঞ্চল, সেখানে সংক্রমণ বেশি। যেখানে সংক্রমণ বেশি, সেখানে মৃত্যুও বেশি। এর ব্যতিক্রমও হয়তো আছে। তাঁর মতে, জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনদের উচিত হবে মৃত্যুর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা। এতে মৃত্যু কমানোর উদ্যোগ নেওয়া সহজ হবে। আর সার্বিকভাবে শুধু সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। এটি পুরো প্রক্রিয়ার একটি অংশ। পরীক্ষার পাশাপাশি আক্রান্তদের আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্ন রাখা) নেওয়া ও চিকিৎসা দেওয়া, তাঁদের সংস্পর্শে আসাদের চিহ্নিত করা, প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণে রাখা—এই কাজগুলো করতে হবে।