চট্টগ্রামের দুঃখ পোর্ট কানেক্টিং সড়ক

চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেক্টিং সড়ক। তিন বছরেও শেষ হয়নি এই সড়কের সংস্কারকাজ। গতকাল বেলা একটায় সরাইপাড়া এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রাম নগরের গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেক্টিং সড়ক। তিন বছরেও শেষ হয়নি এই সড়কের সংস্কারকাজ। গতকাল বেলা একটায় সরাইপাড়া এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের পোর্ট কানেকটিং সড়কের পাশে প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিনিয়োগে ছোট গাড়ি মেরামতের আধুনিক গ্যারেজ বানিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী। ব্যবসা ভালোভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর। বছর তিনেক আগে সড়কটির উন্নয়নকাজের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু এবং মাটির স্তূপ রাখা হয় তাঁর গ্যারেজের সামনে। ফলে ব্যবসা লাটে ওঠে। তিন বছর ধরে বিদ্যুৎ বিল ও কিছু দক্ষ কর্মীর বেতন দিয়ে চলেছেন তিনি।

গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পোর্ট কানেক্টিং সড়কের একটি মসজিদসংলগ্ন প্রতিষ্ঠানে বসে কথা হচ্ছিল মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ব্যবসা বন্ধ থাকায় লোকসানের বোঝা বইতে বইতে তাঁর প্রতিষ্ঠান এখন প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি রাস্তার উন্নয়ন করতে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। একই সময়ের মধ্যে আরেকটি কর্ণফুলী টানেলও বানানো সম্ভব ছিল।’

চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’খ্যাত পোর্ট কানেকটিং সড়কের দুই পাশের হাজারো ব্যবসায়ীর কান্না থামছে না। বছর বছর ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সড়কটির উন্নয়নকাজ শেষ না হওয়ায় শুধু ব্যবসায়ী নয়, হালিশহরের লাখো মানুষ প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। সড়কটির দশা করুণ থাকায় অন্য এলাকার মানুষ সাধারণত ওই এলাকায় পা ফেলতে চান না।

চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও পণ্যবাহী গাড়ি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবহনের জন্য পোর্ট কানেকটিং সড়ক নির্মিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০–১১ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি এই সড়ক দিয়ে বন্দর থেকে সারা দেশে যায় এবং সমপরিমাণ গাড়ি বন্দরে ফিরে আসে। কিন্তু তিন-চার বছর ধরে রাস্তাটির করুণ দশা। এ কারণে ঘুর পথে কদমতলী এবং বিকল্প টোল সড়ক দিয়ে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি মালামাল পরিবহন হচ্ছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম পোর্ট কানেকটিং সড়ককে ‘লাইফ লাইন’ অভিহিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়কটির উন্নয়নকাজ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য আমরা অনেক তাগাদা দিয়েছি। আমাদের কথা শোনা হচ্ছে না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য এটি অন্যতম প্রধান সড়ক।’

মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ‘২০ থেকে ২৫ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি এই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করে আসছিল। এখন ঘুর পথে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। পরিবহন খরচও বেড়েছে। আমরা দ্রুত এ থেকে মুক্তি চাই।’

সরেজমিন যা দেখা গেল
গতকাল সকালে দেখা গেছে, নিমতলা থেকে তাসফিয়া কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত এক পাশের সড়কের উন্নয়নকাজ শেষ। আরেক পাশের উন্নয়নকাজ চলমান আছে। সেখানে মাটি, বালু ও পাথরের স্তূপ। কোথাও আবার খানাখন্দে ভরা। সবচেয়ে করুণ দশা তাসফিয়া থেকে সাগরিকা মাজার পর্যন্ত। এই অংশের মধ্যে পড়েছে নয়াবাজার জংশন। স্থানীয় বাসিন্দারা এই জংশনটি বেশি ব্যবহার করে মূল নগরে আসেন। সড়কের দুই দিকেই বিশাল গর্ত। বৃষ্টি হলে ডোবায় পরিণত হয় সড়ক। তখন গাড়ি উল্টে যায় কিংবা দুর্ঘটনাও বেড়ে যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

নয়াবাজার জংশনের এম আর ট্রেডিং করপোরেশনের কর্মচারী মোহাম্মদ ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, তিন-চার বছর ধরে এই সড়কের কোনো অভিভাবক নেই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নয়নকাজ শেষ না হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ বেড়েছে। সড়কের দুই পাশের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবসা কমে গেছে।

মো. মিরাজ নামের এক ক্রেনচালক জানান, কোরবানি ঈদের আগেও সড়কের পাশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে স্থানীয় বাসিন্দারা। উন্নয়নকাজ শেষ করতে না পারার জন্য তিনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, এই অংশে সড়কের কিছু অংশ ডোবার মতো পরিণত হয়েছে। ফলে গাড়ি হেলেদুলে চলছিল। বৃষ্টির সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ছোট-বড় সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

প্রকল্প পরিচালক যা বলেন
তাহের ব্রাদার্স, মেসার্স মঞ্জুরুল আলম কনস্ট্রাকশন (ম্যাক), মেসার্স রানা বিল্ডার্স ও মেসার্স রানা বিল্ডার্স লিমিটেড-সালেহ আহমেদ (জেভি) নামে চার প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথক লটে ৫ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পোর্ট কানেক্টিং সড়কটির উন্নয়নকাজ করছে। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ‘সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পের’ আওতায় প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৬৮ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর কাজের উদ্বোধন করেন।

সিটি করপোরেশনের প্রকল্প পরিচালক আবু শাহদাত মো. তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় দুটি লটের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আমরা চিন্তিত তাসফিয়া থেকে সাগরিকা মাজার পর্যন্ত উন্নয়নকাজ নিয়ে। এই অংশে মাত্র ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। কাজ শেষ করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে অনেক চিঠি দিয়েছি। এখন আমাদের প্রশাসক মহোদয় দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি সব সমন্বয় করছেন।’

তাসফিয়া থেকে সাগরিকা মাজার পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য দেড় কিলোমিটারের বেশি। এই অংশে মেসার্স মঞ্জুরুল আলম কনস্ট্রাকশনকে (ম্যাক) কার্যাদেশ দেওয়া হয়। প্রকল্প ব্যয় ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় গত ৩০ জুন। তাঁকে নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিমতলা থেকে তাসফিয়া পর্যন্ত দুই লটের কাজের মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের ১৩ মে। এরপর দুই দফায় নভেম্বর পর্যন্ত তাঁদের সময় বাড়ানো হয়েছে।

মেসার্স মঞ্জুরুল আলম কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী মঞ্জুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বরে আমি কার্যাদেশ পেয়েছি। গত ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। লকডাউন ও বর্ষার কারণে সম্ভব হয়নি। নভেম্বর পর্যন্ত আমার সময় বাড়ানো হয়েছে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আমি কাজ শেষ করে দেব।’

নতুন প্রশাসক ক্ষুব্ধ
চট্টগ্রাম সিটির নতুন প্রশাসক খোরশেদ আলম ৬ আগস্ট দায়িত্ব নিয়ে ওই দিনই সড়কটি পরিদর্শনে যান। ১৫ দিনের মধ্যে সড়কের গর্ত ভরাট করে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করে তুলতে তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেন। নইলে ঠিকাদারি লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন।

খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর ধরে একটি রাস্তার উন্নয়নকাজ শেষ হয়নি। ফলে হালিশহরে মানুষ অবরুদ্ধ। তাঁদের সঙ্গে কেউ সামাজিক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে চাচ্ছে না। বৃষ্টির সময় গাড়ি উল্টে যাচ্ছে। জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি আর হতে দেব না।’

খোরশেদ আলম বলেন, ‘সড়কের কাজ দ্রুত শেষ করতে আমি এখানে অফিস স্থাপন করব। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে না পারলে বিকল্প ভাবতে হবে। ওই ঠিকাদারের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। কারণ, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার অধিকার তাদের নেই।’