কর্তাদের হুকুমে ভুতুড়ে বিল, শাস্তি কর্মীদের

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ভুল করে নয়, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েই বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাস নেওয়া। একই সঙ্গে প্রথাগত লোকসান (সিস্টেম লস) কমিয়ে দেখানোর জন্য ভুতুড়ে বিল করা হয়েছিল।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিপিডিসি তাদের ৩৬টি কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে বেশি বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল। ওই নির্দেশে এলাকাভেদে ১০ থেকে ৬১ শতাংশ বেশি বিল করতে বলা হয়। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে বেশি বিল করার দায় এবং এই অপরাধের শাস্তি কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেন পাবেন?

শুধু ডিপিডিসি নয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ (ওজোপাডিকো) দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার গ্রাহকেরা করোনাকালে ভুতুড়ে বিলের খপ্পরে পড়েছিলেন। এর মধ্যে ওজোপাডিকোর বিতরণকৃত ২১টি জেলার মধ্যে তিনটি জেলায় ১৬০ শতাংশের বেশি বাড়তি বিল নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিপিডিসি ছাড়া বাকি বিতরণ সংস্থাগুলো তাদের কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে বাড়তি বিদ্যুতের বিল করার নির্দেশ দিয়েছিল কি না, সেই তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে গ্রাহকদের অস্বাভাবিক বিল পাওয়ার ঘটনা সব কটি বিতরণ সংস্থার বেলায় প্রায় একই রকম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সব কটি কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিয়েই গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি বিল নিয়েছিল।

বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, ছয়টি বিতরণ সংস্থার মোট ৬৫ হাজার গ্রাহককে বাড়তি বিল দেওয়া হয়েছিল, যা পরে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বিতরণ সংস্থাগুলোর নথিপত্র বলছে, এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৭৪ লাখ, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংস্থা আরইবি। ডিপিডিসি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ কোম্পানি হলেও মূলত ঢাকার দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎ বিতরণ করে থাকে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে বিদ্যুতের ব্যবহার কমে গেছে এটি বিদ্যুৎ বিভাগেরই দাবি। ফলে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল বিদ্যুতের বিল কম হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে অনেক বেশি। আসলে সিদ্ধান্ত নিয়েই দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা ভুতুড়ে বিল করেছে। এই অনৈতিক কাজটি যারা করল তাদের বিচার হচ্ছে না।

সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের, দায় কর্মীদের!

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, ডিপিডিসির তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) শাখা থেকে সংস্থাটি ৩৬টি স্থানীয় কার্যালয়ে (এনওসি) চিঠি দিয়ে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের বিল বেশি করতে নির্দেশনা দিয়েছিল। এই বাড়তি বিল ৩৬টি কার্যালয়ে কী পরিমাণ বেশি করতে হবে, তা–ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের তিন মাসের বিলের সঙ্গে তুলনা করে এ বছরের তিন মাসে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ বিল বেশি করতে বলা হয়।

যোগাযোগ করা হলে ডিপিডিসির দুজন ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানী ঢাকার মধ্যে সর্বোচ্চ বিল করার নির্দেশনা ছিল মুগদাতে ৬১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, বাসাবোতে ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বনশ্রীতে ৫৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, মগবাজারে ৫০ দশমিক ৪৪ শতাংশ, আজিমপুরে ৪৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও রাজারবাগে ৪৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ ১৩টি কার্যালয়ের অধীনে থাকা গ্রাহকদের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ৩০ শতাংশ ও নারায়ণগঞ্জ পশ্চিমে ২৫ শতাংশ বিল বেশি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে বাড়তি বিলের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ বিদ্যুৎ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও বিদ্যুতের ‘ভুতুড়ে বিল’ পাঠানো হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন, বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের চারজন কর্মকর্তাসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাসাবাড়িতেও ভুতুড়ে বিল দেওয়া হয়।

হইচইয়ের একপর্যায়ে এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে বিদ্যুৎ বিভাগ গত ২৫ জুন একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি গত ৩ জুলাই প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে পাঁচটি সংস্থার প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে গত ৫ জুলাই ডিপিডিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চার কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। এ ছাড়া ৩৬টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রত্যেক নির্বাহী প্রকৌশলীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়। বদলি করা হয় দুই প্রধান প্রকৌশলীকে। অথচ এসব কর্মকর্তাকে বাড়তি বিল করার নির্দেশনা দিয়েছে খোদ ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ।

>

সবচেয়ে বেশি বিল বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় মুগদাতে ৬১.০৭ শতাংশ
বাসাবোতে ৬০.৮৩ শতাংশ
বনশ্রীতে ৫৬.০৪ শতাংশ

ডিপিডিসির চেয়ারম্যান হলেন বিদ্যুৎসচিব সুলতান আহমেদ। বাড়তি বিল আদায়ের নির্দেশ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে ৮ আগস্ট সুলতান মাহমুদের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি এর জবাব দেননি।

পরিকল্পনা করে চিঠি দিয়ে বিদ্যুতের বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান চাকমা ৮ আগস্ট মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিপিডিসি এমন কোনো চিঠি দেয়নি। বেশি বিল করার কোনো নির্দেশনা আমরা দিইনি।’ প্রথম আলোর কাছে এ–সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ থাকার কথা জানালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তা দেখতে চান। এরপর তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসব প্রমাণ পাঠানো হয়। তিনি সেগুলো দেখলেও এরপর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

ডিপিডিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংস্থাটির ৩৬ জন নির্বাহী প্রকৌশলী সবাই কারণ দর্শানোর জবাব দিয়েছেন। এতে তাঁরা লিখেছেন, প্রতিষ্ঠানের আইসিটি দপ্তর থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল এই তিন মাসের বিদ্যুতের বিল গত বছরের তুলনায় কত বেশি করতে হবে, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী আইসিটি বিভাগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিল তৈরি করে। এরপর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো শুধু সেই বিল প্রিন্ট দিয়ে গ্রাহকের বাসাবাড়িতে পৌঁছে দেয়।

ভুতুড়ে বিল কি এবারই প্রথম?

ডিপিডিসি ও ডেসকোর চার কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রতিবছরই বিদ্যুতের বাড়তি বিল করে তা গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো সিস্টেম লস কমিয়ে দেখানো। কোম্পানিগুলো যে সিস্টেম লস দেখায়, প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে সিস্টেম লস বেশি। তা ছাড়া যে কোম্পানি যত বেশি বিদ্যুতের বিক্রি (সেলস) বেশি দেখাবে, সে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তত বেশি বোনাস পাবেন। অর্থবছরের (১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) শেষ চার-পাঁচ মাসে সাধারণত গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল বেশি করা হয়। এবার ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই তিন মাসে মাত্রাতিরিক্ত ভুতুড়ে বিল করায় বিষয়টি সামনে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, এ অভিযোগ অনেক দিনের। বিতরণ সংস্থাগুলোর আয়-ব্যয়ের প্রকৃত তথ্য চাইলেও তারা দেয় না। তাদের সিস্টেম লস কম দেখানোর জন্য এবং বাড়তি বোনাস পেতে তারা গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত বিল চাপায়, এবার সেটিই প্রমাণিত হয়ে গেল।

কোম্পানিগুলোর নেতৃত্বে কারা?

ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদে ১১ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই হলেন সরকারি কর্মকর্তা। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদটি হলো ডিপিডিসির সভাপতি এবং এই দায়িত্বে রয়েছেন বিদ্যুৎসচিব সুলতান আহমেদ। একই সঙ্গে বিদ্যুৎসচিব ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগকর্তাও। ফলে এ ধরনের কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে সভাপতি বা চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের।

একইভাবে ডেসকোর চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাকসুদা খাতুন, ওজোপাডিকোর চেয়ারম্যান পদে বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব রহমত উল্লাহ মো. দস্তগীর ও নেসকোর চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ বিভাগের আরেক অতিরিক্ত সচিব এ কে এম হুমায়ূন কবীর। এ ছাড়া এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে বিদ্যুৎ বিভাগের আমলাদের একক প্রাধান্য রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ বিভাগের মালিকানাধীন বিতরণ কোম্পানিগুলো করা হয়েছিল বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করার জন্য। এখানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল অনুশাসন ও নজরদারি করার জন্য। সে জন্য কোম্পানিগুলো বাণিজ্যিক পেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালনা করার কথা ছিল। সেটি না করে নজরদারির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাই হয়ে উঠছেন কোম্পানির হর্তাকর্তা। ফলে এখানে স্বার্থের সংঘাত তৈরি হচ্ছে, মন্ত্রণালয় তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা না রেখে কোম্পানির স্বার্থই দেখছে।

জানতে চাইলে অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ডিপিডিসির চেয়ারম্যান বিদ্যুৎসচিব। এখন ডিপিডিসি সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রাহকদের বাড়তি বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা শুধু প্রতারণা নয়, বড় ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটির বিচার যিনি করবেন, সেই বিদ্যুৎসচিব নিজেই ডিপিডিসির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এভাবে প্রতিটি কোম্পানিতে বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বসে আছেন। কোম্পানিগুলোর বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো এসব অপরাধ জায়েজ করছেন। ফলে বিচার চাওয়ার জায়গা অবশিষ্ট থাকছে না।