সিগারেট খাওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার, পরে পুলিশকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি

সোহেল মীর। ছবি: সংগৃহীত
সোহেল মীর। ছবি: সংগৃহীত

সোহেল মীর নামের এক ব্যবসায়ীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা আদায় করার অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার ওসিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে। এর আগে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের সামনে সোহেল মীর ‘মাদকদ্রব্য’ সিগারেট খেয়েছিলেন, এমন অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়।

ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে সোমবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি আসামিরা হলেন কোতোয়ালি থানার এসআই পবিত্র সরকার, এসআই খালিদ শেখ, এএসআই শাহিনুর রহমান, কনস্টেবল মিজান ও পুলিশের সোর্স মোতালেব।

মেডিকেল কলেজে ধূমপান করার অপরাধে সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হলেও বিষয়টি জানেন না মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ–উন নবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পরদিন (২ আগস্ট) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ছাড়া সবকিছু বন্ধ ছিল। আর মেডিকেল কলেজ তো আগে থেকেই বন্ধ। তাঁর হাসপাতাল থেকে সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করার কথা তিনি জানেন না। কোতোয়ালি থানা–পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে কিছুই জানানো হয়নি।

অভিযোগের ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। বক্তব্য জানতে কথা বলার জন্য অভিযুক্ত কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নুর আলম প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল মীর নামের এক ব্যক্তি তাঁদের থানার ওসিসহ পাঁচজনের নামে আদালতে মামলা করেছেন বলে জানতে পেরেছেন।

মামলার কাগজপত্র এবং ভুক্তভোগী সোহেল মীরের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোহেল মীর (৫৫) পেশায় একজন ব্যবসায়ী। স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এলাকায়। কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জে কাপড়ের দোকান রয়েছে। তাঁর মেয়ে থাকে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায়। মেয়ের বাসায় আসার জন্য ২ আগস্ট বিকেলে সোহেল কালীগঞ্জ থেকে নৌকায় করে সদরঘাটের ওয়াইজঘাটে আসেন। এরপর আম্বিয়া টাওয়ারের সামনে আসার পর কোতোয়ালি থানার এসআই পবিত্র সরকার, এসআই খালিদ শেখ, এএসআই শাহিনুর রহমান, কনস্টেবল মিজান ও পুলিশের সোর্স মোতালেব সোহেলকে ঘিরে ধরেন।

সোহেল মীর। ছবি: সংগৃহীত
সোহেল মীর। ছবি: সংগৃহীত

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আমার দেহ তল্লাশি করে। কিন্তু আমার কাছে তারা কিছু পায়নি। তবে আমার কাছে টাকা ছিল মোট ২ হাজার ৯০০। তখন ওই টাকা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেন এসআই খালিদ। এরপর তাঁরা আমাকে চলে যেতে বলেন। আমি টাকা চাইলে সবাই মিলে আমাকে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। আমাকে মারধর করতে দেখে কয়েকজন লোক সেখানে চলে আসেন। পুলিশ এগিয়ে আসা লোকজনকে বলেন, আমার কাছ থেকে ২১৪টি ইয়াবা পাওয়া গেছে। কনস্টেবল মিজান নিজের পকেট থেকে ইয়াবা বের করে মানুষকে দেখান। পুলিশ তাদের আরও বলেন, আমার নামে নাকি জেএমবির মামলা আছে। সেই মামলায় আমার নামে নাকি ওয়ারেন্ট আছে। তখন আমাকে পুলিশ টানাহেঁচড়া করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে হাজতখানায় এনে রাখে।’

সোহেল মীরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর তাঁর মুঠোফোন থেকে স্ত্রী সাবিনা খাতুনকে ফোন দেয় পুলিশ। তখন সোহেল মীর থানায় আটক হওয়ার কথা জানান স্ত্রীকে।

সোহেলের স্ত্রী সাবিনার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন এসআই খালিদ শেখ। সাবিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কোতোয়ালি থানায় আসতে বলেন। থানার ফোন পেয়ে আমি কোতোয়ালি থানায় আসি। থানায় বসে এসআই খালিদকে ফোন করলে তিনি আমাকে নয়াবাজার ব্রিজের গোড়ায় আসতে বলেন। সেখানে এসআই খালিদ স্বামীকে ছাড়াতে চাইলে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসার কথা বলেন। না হলে স্বামীকে ক্রসফায়ার করবেন বলে হুমকি দেন।’

টাকা দেওয়ার বিষয়ে সাবিনা তাঁর স্বামী সোহেলের সঙ্গে কথা বলতে থানায় যান। সেখানে সাবিনার সঙ্গে কথা বলেন এসআই পবিত্র সরকার, এসআই খালিদ ও এএসআই শাহীন। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার সামনে কথা না বলে থানার ভেতর অন্য স্থানে সাবিনার সঙ্গে কথা বলেন ওই তিন পুলিশ কর্মকর্তা। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে থানায় গিয়ে ২ লাখ টাকা দেন সাবিনা। টাকাটা নেন এসআই পবিত্র সরকার ও এসআই খালিদ। সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন এসআই শাহীন। খালিদ আরও দেড় লাখ টাকা সকালের মধ্যে দিতে বলেন সাবিনাকে। খালিদ সাবিনাকে বলেন, ‘সোহেলকে আমরা পাঁচআনি (ডিএমপি অ্যাক্ট) মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করব। আমরা আমাদের উকিল দিয়ে সোহেলকে ওই দিনই ছাড়িয়ে আনব।’

পরদিন সকাল ৯টায় থানায় গিয়ে সাবিনা দেড় লাখ টাকা দিয়ে আসেন। পরে ওই দিনই (৩ আগস্ট) আদালত থেকে ছাড়া পান সোহেল মীর।

সাবিনা বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আদালত তদন্ত করার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি। আমরা নিরাপত্তা চাই। আমরা সুবিচার চাই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব বিজয় তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন,‌ ‘এ রকম একটি মামলা হয়েছে জেনেছি। তবে আমরা এখনো অফিশিয়ালি কাগজটা হাতে পাইনি। অফিশিয়ালি কাগজটা হাতে পাওয়ার পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা কমিটি কীভাবে করব? যেহেতু অফিশিয়াল কোনো কাগজপত্র পাইনি। আমরা শুনে কিংবা টিভির ব্রেকিং নিউজ দেখে তো কোনো কমিটি করতে পারব না। অফিশিয়ালি আমাদের নোটিশে আসতে হবে।’