যা কিছু পাই, হারায়ে যায়

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

সব সময় খবরের কাগজে বা বইয়ে পড়তাম কিংবা খবরে শুনতাম, তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ভাবতাম, আহা, একজন মানুষ মারাই গেলেন শেষমেশ! মাত্র এক শুক্লপক্ষ আগে চোখের সামনে আমার আব্বুও শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন। একেই বুঝি বলে ভবিতব্য।

যখন আব্বুর অন্তিম মুহূর্ত, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জামিল আমাকে ধরে রেখেছিল। ভেবেছিল, হয়তো আইসিইউর রেড জোনের ভেতরে অন্য রোগীদের অসুস্থতাকে উপেক্ষা করে আমি চিৎকার করে উঠব। আমি কিছুই করলাম না। কিছুই হলো না। আমার চিৎকারে যদি আব্বুকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিতেন, আমি তা–ই করতাম।

গত ২২ জুলাই চিকিৎসকদের ব্রিফিংয়ের পরই মনকে বুঝিয়েছি। শক্ত হয়েছি তো আরও আগে, যেদিন আব্বুর ভেন্টিলেশনের অনুমোদনের কাগজে স্বাক্ষর করেছি। আব্বুকে গিয়ে বুঝিয়েছি কেন ভেন্টিলেশন লাগবে। আব্বু বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, ‘যাও, ডিউটি ডাক্তারকে বলো, আজ রাত থেকেই যেন শুরু করে।’ চিকিৎসককে জানিয়েছিলাম সে কথা। আব্বু নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে হয়ে গেল করোনা।

৬ থেকে ২৩ জুলাইয়ের একেকটা ক্ষণ আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রকৃত বয়সের চেয়েও বড় করে দিয়েছে। তাই মা আর শেফাকে আমার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আব্বু নীরবেই বিদায় নিলেন। তবু তাতে আমাদের বন্ধন কি ছিন্ন হয়েছে? ছিন্ন কি হয় আসলে?

ফিরে আসি শুক্লপক্ষের বিকেলে। দাদুমণির হাত ধরে সেই তিন–চার বছর বয়সে আমার ধর্মীয় শিক্ষা শুরু হয়েছিল। বাকিটা আম্মু-আব্বুর প্রয়াস। তাঁদের দেখে দেখে যতটা পেরেছি শিখেছি। যখন একটু একটু করে আব্বুর হৃদ্‌যন্ত্রের স্পন্দন কমে আসছিল, তখন আব্বুর প্রিয় সব আয়াত শেষবারের মতো শুনিয়েছি। আব্বু শুনেছিলেন কি না, জানি না। শেষবারের মতো এক ফোঁটা জমজমের পানি মুখে দিয়ে দিয়েছি। ওই পানি দিয়ে চোখমুখ মুছে দিয়েছি। তার সঙ্গে আমার চোখের পানিও মিশে গিয়েছিল কি না, বলতে পারব না। মনিটরের টিপ টাপ আওয়াজ তখন আমার বুকে যেন যুদ্ধ শেষের দামামা বাজাচ্ছে। তখনো বলেছি, ‘খোদা, আমাকে নিয়ে যাও, আব্বুকে ফিরিয়ে দাও!’

জীবদ্দশায় কখনো আব্বুকে লক্ষ্মী আব্বু, সোনা আব্বু—এসব বলিনি। আব্বুকে শেষবার ঘুমাতে যেতে দেখে মন থেকে অজান্তেই বললাম, ‘সোনা বাচ্চা, লক্ষ্মী আব্বু আমার, যাও তাহলে এবার তুমি আল্লাহর কাছে! তুমি কিচ্ছুতে হেরে যাওনি।’

আমি বড় সন্তান। আব্বুর চলে যাওয়ার পরিক্রমায় যেন আরও বড় হয়েছি। শক্ত থেকেছি, ভেন্টিলেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মৃত্যুসনদে
স্বাক্ষর করে আব্বুকে মানে তাঁর ‘ডেডবডি’ বুঝে নিয়েছি। মারা যাওয়ার তিন দিন আগে থেকে কোথায় দাফন করা হবে, চাচা-ফুফুদের সঙ্গে তা আলাপ করে ঠিক করেছি। আব্বুকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছন বনানী কবরস্থানে গিয়েছি। জানাজা আর দাফন শেষে বাসায় ফিরেছি। বাসায় ফিরে স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন হয়েছি।

১৪ দিন পার হলো। রোদ উঠল। সূর্য ডুবল। বৃষ্টি হলো। হজ হলো। কোরবানিও হলো। শুরু হলো অফিস। নিয়মমতো খাওয়াদাওয়া করি। সব হয়। সব করি। সব চলে। কিচ্ছু থামে না। কিচ্ছু থেমে নেই।

ভাবি, আব্বু কি দেখতে পাচ্ছেন আমাদের? ওয়ারীর বাসায় সবকিছু ঠিকঠাক আছে। শুধু আব্বুই নেই। আব্বুর সাজানো বুকশেলফগুলো কী সুন্দর গোছানো! আব্বু নিজেই গোছাতেন। ছোটবেলা থেকে আব্বুকে তো বাসার সব গাছের পাতা মুছতে দেখেছি! কাজটা আমারও খুব ভালো লাগে। আমিও ছোটবেলা থেকেই গাছদের আদর করি। ওদের পাতা মুছে দিই। নিজের বুকশেলফগুলোও আমি মুছি, সাজাই, গোছাই। তাতে কি, তাতেও কি আব্বুর ভালোবাসার অসীম ক্ষমতার এক কণাও আয়ত্ত করতে পারব?

বড় সন্তানেরা নাকি দুর্ভাগা হয়। নাকি দুর্ভাগারাই বড় সন্তান হয়!