করোনা বুলেটিন বন্ধে সংক্রমণঝুঁকি বাড়বে

করোনাকালে দেশের মানুষের বড় আগ্রহের জায়গা ছিল স্বাস্থ্য বুলেটিন। ফাইল ছবি
করোনাকালে দেশের মানুষের বড় আগ্রহের জায়গা ছিল স্বাস্থ্য বুলেটিন। ফাইল ছবি

দেশের মানুষকে সরাসরি করোনা মহামারির তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দিল সরকার। আজ বুধবার থেকে অনলাইন স্বাস্থ্য সংবাদ বুলেটিন প্রচার করবে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে গুজবের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে গেল।

সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তথ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে সচেতন ও সতর্ক করার জন্য ঠিক সময়ে ঠিক বার্তা দেওয়ার গুরুত্বের কথা বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের ব্যাপারে শুরু থেকে অবহেলা দেখিয়েছে। তারপরও সংবাদ বুলেটিনের মাধ্যমে সরাসরি যে তথ্য সাধারণ মানুষ পেতে, সেটিও বন্ধ হয়ে গেল।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় নিয়মিত স্বাস্থ্য সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘আগামীকাল (আজ বুধবার) থেকে এই অনলাইন ব্রিফিং আর হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ব্রিফিং না হওয়ার কারণে তথ্যপ্রবাহে অসুবিধা হবে না। নিয়মিতভাবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।

করোনাকালে দেশের মানুষের বড় আগ্রহের জায়গা ছিল বেলা আড়াইটার স্বাস্থ্য বুলেটিন। বুলেটিনে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা, আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা, সুস্থ হওয়ার সংখ্যা, হাসপাতালে শয্যা পরিস্থিতি ইত্যাদি নানা ধরনের তথ্য দেওয়া হতো। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের প্রায় সব বেসরকারি টেলিভিশন এই সংবাদ বুলেটিন সরাসরি প্রচার করত। রাস্তাঘাটে মানুষকে মুঠোফোনে বুলেটিন শুনতে দেখা গেছে। দেশের প্রায় সব সংবাদপত্র এই বুলেটিনের তথ্য নিয়মিতভাবে প্রকাশ করে আসছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনলাইন ব্রিফিং আপাতত বন্ধ থাকবে।’ আপাতত বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধ্যাপক নাসিমা সুলতানার পক্ষে দীর্ঘদিন টানা বুলেটিন পাঠ করে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্য অতিরিক্ত মহাপরিচালক অবসরে যাচ্ছেন। নতুন অতিরিক্ত মহাপরিচালক এলে আবার ব্রিফিং চালু করা হবে।

দেশে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এর আগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) করোনা বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং চালু করে জানুয়ারি মাসে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় এই ব্রিফিং করতেন। অল্প দিনেই এই ব্রিফিং সংবাদকর্মী ও গণমাধ্যমের দর্শক-পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সংক্রমণঝুঁকির বিষয়গুলো সামনে চলে আসার পরপরই সরাসরি ব্রিফিং বন্ধ হয়ে যায়।

২৩ মার্চ থেকে অনলাইন ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনলাইন ব্রিফিংয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল। ৬ এপ্রিল পেশাজীবীদের এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে নতুন ২৯ জনের কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন ৪ জন। আর মীরজাদী সেব্রিনার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে সংখ্যাগুলো ছিল ভিন্ন। দুই রকম তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিকেরা। সাংবাদিকেরা জানতে চান, কার তথ্য সঠিক। এর পরদিন থেকে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্রিফিংয়ের নাম হয় ‘দৈনন্দিন স্বাস্থ্য বুলেটিন’।

এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য বুলেটিন পাঠ করার দায়িত্ব থেকে বাদ পড়েন আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। তখন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানাই বুলেটিনের দায়িত্বে ছিলেন। মাঝে কয়েক দিন তাঁর সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তাকেও যুক্ত হতে দেখা গেছে। তবে এই দায়িত্বটি ঠিক কার, তা কখনো সুনির্দিষ্ট করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মহামারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঝুঁকি যোগাযোগ বা রিস্ক কমিউনিকেশনের ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বারবার বলেছে, মহামারি বিষয়ে মানুষকে ঠিক তথ্য ঠিক সময়ে দিতে হবে। অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক বা সাত দিনে সংক্রমণঝুঁকি কমেছে না বেড়েছে, সংক্রমণের ক্ষেত্রে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, জনগণের করণীয় নিয়মিতভাবে জানানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দক্ষতার সঙ্গে ও পেশাদারির সঙ্গে কাজটি করতে পারেনি। স্বাস্থ্য বুলেটিনে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার ভুল পরিসংখ্যান, করোনা রোগী ও শয্যার অর্ধসত্য তথ্য দেওয়ার নজিরও আছে।

অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা স্বাস্থ্য বুলেটিন পাঠ করতে অপরাগ, এমন কোনো কথা দ্বিতীয় কারও কাছ থেকে শোনা যায়নি। গতকাল যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোর কাছে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে বুলেটিন পাঠ করার মতো দক্ষ একাধিক পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আছেন বলে জানা গেছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মহামারির তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সরকার কখনোই ঠিক পথে ছিল না। বুলেটিন বন্ধ করে আরও বড় ভুল করল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, এখন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা চলছে। মানুষ সরকারের কাছে ভরসা চায়। বুলেটিন বন্ধ করে সেই ভরসার জায়গা নষ্ট করা হলো।

একাধিক জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন, বুলেটিন বন্ধ করায় ভুল বার্তা যাবে মানুষের কাছে। অনেকে মনে করবেন, মহামারি গুরুত্ব হারিয়েছে। মানুষ ইচ্ছেমতো ঘরের বাইরে যাবেন। যাঁরা মাস্ক পরতেন, তাঁরা মাস্ক পরা বন্ধ করে দিতে পারেন। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনাবিষয়ক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জানি না। তবে অনতিবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে বুলেটিন চালু করতে হবে।’