নতুন রোগী বৃদ্ধির বৈশ্বিক তালিকায় আবার দেশ

দেশে করোনা সংক্রমণে দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যায় আবারও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নতুন রোগী বেশি বাড়ছে এমন দেশগুলোর বৈশ্বিক তালিকায় আবার বাংলাদেশের নাম এসেছে। 

নতুন রোগী শনাক্ত বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রতিদিন ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। ইতিমধ্যে দেশে সংক্রমণের ১৫৮ দিনের মাথায় করোনায় সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের দিন থেকে হিসাব করলে প্রতিদিন গড়ে ২২ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪২ জন।

এক সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি নতুন রোগী বেড়েছে বিশ্বের এমন শীর্ষ ১২টি দেশের তালিকা প্রকাশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জুনের শুরু থেকে ওই তালিকায় স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম থেকে ১২-এর মধ্যে ওঠানামা করে। তবে আগস্টে এসে সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ওই তালিকায় বাংলাদেশ ছিল না। এখন আবার তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ১২ নম্বরে। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেশি ছড়ায় লোকসমাগমের মাধ্যমে। সাধারণত সংক্রমিত হওয়ার দুই দিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ উপসর্গ প্রকাশ পায়। অনেকে আবার আক্রান্ত হলেও কোনো লক্ষণ উপসর্গ থাকে না। সে হিসাবে পবিত্র কোরবানির ঈদকেন্দ্রিক পশুর হাট ও বাড়িতে যাতায়াতে যেভাবে লোকসমাগম হয়েছে, তাতে সংক্রমণ অনেক ছড়িয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রে সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যায়নি। এখন এর প্রভাব দেখা যেতে শুরু করেছে। 

দেশে ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের কথা নিশ্চিত করে সরকার। জুন মাসে গিয়ে পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে। এমন পরিস্থিতিতে জুলাইয়ের শুরু থেকে পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাওয়ায় নতুন রোগী শনাক্ত কমতে শুরু করে। জুনে গড়ে প্রতিদিন নতুন রোগী শনাক্ত ৩ হাজারের ওপরে ছিল। জুলাইয়ে সেটি ৩ হাজারের নিচে নেমে আসে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে-পরে এক সপ্তাহে দৈনিক নতুন রোগী শনাক্ত নেমে এসেছিল প্রায় ২ হাজারে। এ সময় অবশ্য পরীক্ষাও অনেক কম হয়েছিল। এখন আবার প্রতিদিন পরীক্ষা গড়ে ১০ হাজারের বেশি হচ্ছে। নতুন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।

ঈদের আগে-পরে এক সপ্তাহে (৩১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট) দৈনিক রোগী শনাক্তের গড় ছিল ২ হাজার ৬৮। তারপর থেকে গত এক সপ্তাহে (৬-১২ আগস্ট) দৈনিক রোগী শনাক্তের গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৩২। এর মধ্যে গত টানা তিন দিন ২ হাজার ৯০০ জনের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

প্রতি তিন দিনের নতুন রোগী শনাক্তের গড়ের ভিত্তিতে বিশ্বের কোন কোন দেশে বেশি রোগী বাড়ছে, তার হিসাব প্রকাশ করে আওয়ারওয়ার্ল্ড ইন ডাটা নামের একটি ওয়েবসাইট। এটি শুরু থেকেই বিশ্বের সব দেশের করোনা পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করে আসছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১১ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনের গড়ে নতুন রোগী বাড়ার বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এই তালিকায় সবার ওপরে আছে ভারত। অন্যদের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরু, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো ও রাশিয়া।

সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মৃত্যু 

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা) দেশে আরও ২ হাজার ৯৯৫ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৯৮। আর গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪২ জন। এ নিয়ে মোট মারা গেলেন ৩ হাজার ৫১৩ জন।

এসব মৃত্যুর বাইরে প্রায় প্রতিদিন করোনা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃত্যুর খবর আসছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের একটি প্রকল্প বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) এ ধরনের মৃত্যুর খবরের হিসাব রাখছে। তাদের হিসাবে, ১ আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৯৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের সময়ের লোকসমাগমের প্রভাব ধীরে ধীরে দেখা যাচ্ছে। তাঁর বিশ্লেষণে গত কিছুদিন ধরে ঢাকা ও ৬০ শতাংশ জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। আগামী সপ্তাহে নতুন রোগী আরও বাড়তে পারে। তার সপ্তাহখানেক পর থেকে মৃত্যুও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি রোগীদের আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন করা), আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করা, তাঁদের নিয়মিত খোঁজ নেওয়া—এই কাজগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সরকারকে করতে হবে। পাশাপাশি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দ্রুত এসব পদক্ষেপ নিলে পবিত্র ঈদুল আজহাকেন্দ্রিক জনসমাগমের ধাক্কাটা কিছুটা হলেও সামলানো যাবে।