রক্তের দাগ থেকে ধরা পড়ল খুনি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বসতঘরের আসবাব সব তছনছ করা। প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে খোলা ল্যাট্রিনের রিংয়ে পা উপুড় করা অবস্থায় পাওয়া যায় ওই বসতঘরের বাসিন্দা নারীর লাশ। নিহত ওই নারীর নাম জুলেখা বেগম (৪৫)।

পুলিশ ও প্রতিবেশীদের ধারণা, ঘরের কোনো কিছু লুট করে নিতে ওই নারীকে খুন করে লাশ গুম করতেই ফেলা হয়েছে ল্যাট্রিনে।

লাশ উদ্ধারের সময় ল্যাট্রিনের পাশে দেখা যায়, ছোপ ছোপ রক্ত। উদ্ধার করা লাশের গা থেকে কোনো রক্ত ঝরেনি। তাহলে এই রক্ত কার? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রক্তের দাগ দেখে দেখে খুনির গন্তব্য শনাক্ত হয়। পরে গ্রেপ্তার করা হয় কাচ দিয়ে সদ্য পা কাটা একজন যুবক ও তাঁর দুজন সঙ্গীকে।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁওয়ের মোল্লাটিলা এলাকায় গত বুধবার রাতে ওই নারীকে খুনের ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনা বৃহস্পতিবার উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়া জুলেখা প্রায় চার মাস ধরে দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছিলেন মোল্লাটিলার একটি ভাড়া বাসায়। দুই ছেলে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। প্রতিদিন সকালে কাজে যান, কাজ শেষে ঘরে ফেরেন সন্ধ্যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মা জুলেখাকে পাননি দুই ছেলে। ঘর তছনছ থাকায় প্রতিবেশীদের নিয়ে মাকে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ঘর থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একটি খোলা ল্যাট্রিনের মধ্যে মায়ের লাশ দেখে ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পুলিশকে খবর দেন। রাত ১১টার দিকে পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে।

ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. খালেদ চৌধুরী বলেন, জুলেখার গলায় গামছা প্যাঁচানোর চিহ্ন ছিল। এতে ধারণা করা হয়, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। তবে শরীরে কোনো জখমের চিহ্ন ছিল না। কিন্তু ল্যাট্রিনের পাশে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে সন্দেহ হয়। বুধবার রাত ১১টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত রক্তের দাগ দেখে অজ্ঞাতপরিচয় খুনির গন্তব্য শনাক্ত করা হয়। সকাল ১০টার দিকে মোল্লাটিলা এলাকার একটি গরুর খামারে গিয়ে রোকন ওরফে কালু (২০) নামের এক যুবকের বাঁ পায়ে কাচের কাটার জখম দেখা যায়। পরে কালুর এক সহযোগী ইন্দ্র (২১) ও ১৪ বছর বয়সী একজনসহ তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে জিজ্ঞাসাবাদে তিনজন স্বীকার করেন জুলেখা হত্যার ঘটনা।

শুক্রবার তিনজনের জবানবন্দি আদালতে ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. লুৎফর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুলেখা তাঁর দুই ছেলের রোজগার থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতেন। এই টাকা দিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। ওই টাকা জমানোর বিষয়টি কালু তাঁর এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। বুধবার সন্ধ্যার পর সেই টাকা চুরি করতে জুলেখার ঘরে ঢোকেন তিনজন। এ সময় জুলেখা বাধা দিলে তাঁকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে লাশ ল্যাট্রিনে ফেলে দেন তাঁরা। লাশ ফেলার সময় কালুর বাঁ পায়ে কাচের টুকরায় কেটে যায়। কাটা পা থেকে রক্ত ঝরছিল, যা দেখে পুলিশ খুনি শনাক্ত করেছে।

ফেঞ্চুগঞ্জ থানার পরিদর্শক মো. খালেদ চৌধুরী বুধবার রাত ১১টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত একটানা ১১ ঘণ্টা ওই ঘটনার পেছনে ছিলেন। ‘ক্লুলেস’ হত্যাকাণ্ডটি শেষ পর্যন্ত রক্তের দাগ দেখে উদ্‌ঘাটন করা হয়েছে জানিয়ে লুৎফর রহমান আরও বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছেন জুলেখার বড় ছেলে মো. রুমান আহমদ (২১)। মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। জুলেখার জমানো ছিল ৮ হাজার ৮৬৮ টাকা। সেই টাকা তিনজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।

মো. রুমান আহমদ তাঁর ছোট এক ভাইকে নিয়ে ওয়ার্কশপে কাজ করেন। রুমান জানান, প্রায় পাঁচ মাস আগে তাঁর বাবা মাকে তালাক দেন। এরপর থেকে তাঁরা দুই ভাই মাকে নিয়ে মোল্লাটিলা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছিলেন। কাজের জন্য প্রতিদিন তাঁরা দুই ভাই সকালে ঘর থেকে বের হতেন, ফিরতেন সন্ধ্যার পর। ঘরে ফিরে দৈনিক রোজগারের টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতেন। রুমান আরও বলেন, ‘ওই দিনও ৩০০ ট্যাখা মার হাতও দিবার লাগি গেছি। গিয়া দেখি মা নাই। এরপর লাশ পাইলাম। জমাইল ট্যাখা বিষয়টা কালু জানছিল। এই জানাটাই শেষ পর্যন্ত কাল অইল। আমরা মারে হারাইলাম।’