ঘরবন্দী ঈদ, জন্মদিনে মৃত্যু

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

জন্ম আমার নানির বাসায়। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে। আম্মার কাছে শুনেছি, নানা–নানি আগে আসকারদীঘির পাড় এলাকায় থাকতেন। তখন সিজিএস কলোনির ভবনগুলো সবে গড়ে উঠছে। নানা কাস্টমস কর্মকর্তা ছিলেন। একই সঙ্গে ছিলেন একজন স্পোর্টসম্যান। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ফুটবল খেলতেন।

সিজিএস কলোনি তখন সবে গড়ে উঠছে। নানা সিজিএস কলোনিতে একটা বাসা পেয়ে আসকারদীঘির বাসা ছেড়ে কলোনিতে ঢুকলেন। আমার কয়েক মামার জন্মও এই কলোনিতে। সেই যে তাঁরা ঢুকলেন তো ঢুকলেন। এরপর নানা অবসর নিলেন। বড় মামা যোগ দিলেন সরকরি চাকরিতে। সেই সুবাদে বাসাটা মামার নামে পুনর্বরাদ্দ হলো। নানা মারা গেলেন ১৯৯৩ সালে। বছর দুয়েক আগে মামা অবসর গ্রহণ করলেন। এবার বাসা ছাড়তে হবে।

এদিকে কলোনির বাসাগুলোও জরাজীর্ণ হয়ে ওঠায় সরকারি আদেশে ভবন ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। নানি সেই যে কলোনিতে ঢুকেছিলেন, বের হলেন বছরখানেক আগে। এই বাড়িতে ৬৫ বছরের দীর্ঘ আবাস। নানি যখন কলোনিতে এসেছেন, তখন সারা দিন ইটবোঝাই ট্রাক ঢুকত কলোনির ভবন তৈরির কাজে। আর যখন তিনি বেরিয়ে এলেন, তখনো ট্রাক ঢুকছে। তবে এবার সেসব ভেঙে ফেলে দালানগুলোর আবর্জনা সরানোর কাজে।

কলোনির সেই বাসায় একটা দেয়াল আলমারি ছিল। সেটির চাবি থাকত নানির আঁচলে। আমাদের কাছে সেই আলমারি ছিল রহস্যময়। মাঝেমধ্যেই সেই আলমারি থেকে জাদুমন্ত্রের মতো বের হয়ে আসত মজাদার বিস্কুট বা মহার্ঘ পাঁচটি টাকা। নানি আমাদের কাছে ছিলেন সম্রাজ্ঞীর মতো। তাঁর নির্দেশে খাজাঞ্চিখানার দরজা খুলে যেত। আর আমরা ‘মণিরত্ন–হীরা–জহরত’ গ্রহণ করে ধন্য হতাম। 

তিনি আলগা স্নেহ–মমতা–আদর কখনোই দেখাতেন না। তাঁর তকতকে পরিষ্কার টানটান বিছানায় আমাদের ওঠা নিষেধ ছিল। কিন্তু আদরের কমতি তিনি রাখেননি। টিফিন ক্যারিয়ারভর্তি তালের পিঠা, পাকন পিঠা যখন আমাদের বাসায় এসে পৌঁছাত, তখন সেই আদর আর স্নেহ বোঝার মতো বয়স আমাদের হয়নি। যখন ঈদের নতুন পোশাক হবে কি হবে না, এই সিদ্ধান্তে ভাইবোনেরা দোদুল্যমান—তখন নানা–নানি এসে হাজির হতেন সবার এক সেট নতুন পোশাক নিয়ে।

আমার জন্মের সময় সম্ভবত ধাইয়ের কাছ থেকে নানিই আমার ছোট দেহটি গ্রহণ করেছিলেন। 

নানি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। বয়সও হয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল, তিনি করোনা আক্রান্ত। ৩১ জুলাই রাত ১১টার দিকে ডাক্তার জানালেন, সংকটাপন্ন অবস্থা। ফুসফুস সফলভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের করতে পারছে না। রক্তে জমছে কার্বনের বিষ। এই বিষে দেহের অন্য অর্গানগুলোও মরে যাচ্ছে। সম্ভবত এই রাতটাই তাঁর শেষ রাত। নানির জীবন রক্ষার প্রার্থনা আমিও আর করছি না। শুধু নানির চলে যাওয়াটা যেন সহজ হয়, তিনি যেন কোনো কষ্ট না পান, তাঁর চলে যাওয়ার পালকি যেন হয় নরম তুলা আর মখমলে মোড়ানো। তিনি এ রকম আরামেই তাঁর নাতি–নাতনিদের রেখেছেন সারা জীবন। 

এল পয়লা আগস্ট। ঈদুল আজহা। এই দিনটা আবার ঘটনাচক্রে আমার জন্মদিনও। সবার শুভেচ্ছায় সিক্ত। কিন্তু হৃদয় বিদীর্ণ করা করা খবরটি এল রাত সোয়া তিনটার দিকে। রাত ২টা ৪৫ মিনিটে নানি তাঁর শেষনিশ্বাসটি ত্যাগ করেছেন। 

তিনি আমাদের সম্রাজ্ঞী ছিলেন, সম্রাজ্ঞী হয়েই থাকবেন। সামান্য মৃত্যুতে কোনো মহারানির কীই–বা আসে যায়। একজন মানুষ মাটিতে মিশে যাওয়ার আগে কত বছরই বা বাঁচে? মহাপ্রাণেরা বেঁচে থাকে মহাকালজুড়ে।