করোনামুক্ত হলেও অনেকে নানা জটিলতায় ভুগছেন

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

রাজধানীর কাঁঠালবাগানের এক গৃহিণী জুনের প্রথম সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। তিন দিনে ডায়রিয়া পুরোপুরি ভালো হওয়ার আগেই হালকা জ্বর দেখা দেয়। জ্বর থাকতে থাকতেই তিনি খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেন। খাবার বা অন্য সবকিছু তাঁর কাছে গন্ধহীন হয়ে পড়ে। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহর তত্ত্বাবধানে ১৫ জুন ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষায় এক দিন পর তাঁর কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই গৃহিণীকে একপর্যায়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। ২৮ জুন সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন ওই গৃহিণী। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পেটে গ্যাসের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। করোনার পর বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, ঘুমের জন্য রাতে ওষুধ খেতে হয়। আগে এই অভ্যাস ছিল না।

গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন বয়সী ও বিভিন্ন পেশার ২০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা
হয়েছে। তাঁরা করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এখন সুস্থ। তাঁদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই বলেছেন, করোনার কারণে নতুন শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে যেসব সমস্যা ছিল না। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এক সংবাদকর্মী বলেছেন, তিনি কম্পিউটার ও মুঠোফোনের পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারছেন না। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের এক ব্যবস্থাপক বলেছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার দুই মাস পরও তিনি ডায়রিয়াজনিত সমস্যায় ভুগছেন।

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোগটা একেবারে নতুন। প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় জানতে পারছি। তবে যাঁরা সুস্থ হচ্ছেন, তাঁদের চিকিৎসকের সংস্পর্শে বা ফলোআপের আওতায় থাকতে হবে।’

গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর এই রোগ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা শুরু হয় এবং এখনো তা অব্যাহত। শুরু থেকেই একে মারাত্মক তীব্র শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিভিয়ার ইকুইট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফুসফুসসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে এই ভাইরাস বাসা বাঁধতে বা বেঁচে থাকতে পারে। তবে মল, মূত্র ও রক্ত নিয়ে একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুস বা শ্বাসতন্ত্রের বাইরে শরীরের অন্য স্থানেও এই ভাইরাস বাসা বাঁধতে বা বেঁচে থাকতে পারে।

জুলাই মাসে নেচার মেডিসিন সাময়িকীতে একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কিডনি, হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি, পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্রের কলায় (টিস্যু) এই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে, এমন নজির পাওয়া গেছে। কোন টিস্যু কীভাবে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তার বর্ণনা আছে ‘একস্ট্রাপালমুনারি ম্যানিফেস্টেশন অব কোভিড-১৯’ শীর্ষক প্রবন্ধে। ওই প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসে টিস্যু বা কলা সরাসরি আক্রান্ত হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

শরীরের কোন তন্ত্র (সিস্টেম) ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কোন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়, তার সচিত্র বর্ণনা আছে ওই প্রবন্ধে। যেমন স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হলে তা মাথাব্যথার কারণ হয় বা মাথা ঘোরানোর লক্ষণ দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুতন্ত্র স্ট্রোকেরও কারণ হতে পারে। একইভাবে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তীব্র কিডনি রোগ দেখা দিতে পারে। পরিপাকতন্ত্র আক্রান্ত হলে ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে। একইভাবে রক্ত জমাট বাঁধা, হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার কথাও তাতে বলা আছে।

জুনের ৩০ তারিখ রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজার এলাকার এক বাসিন্দাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। চিকিৎসার একপর্যায়ে ওই ব্যক্তির রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, ওষুধের কারণে রক্তে শর্করা বেড়েছিল। ওই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন না। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার এক মাস পরও তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। নেচার মেডিসিন-এর ওই প্রবন্ধ বলছে, করোনা ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক রাশেদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ছয় মাসে করোনার রোগীকে রক্ত জমাট বাঁধা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার নজির দেখেছি। অন্যদিকে ২৮ শতাংশ রোগীকে ডায়রিয়ায় ভুগতে দেখেছি। নিজের অভিজ্ঞতায় বলছি, করোনা শুধু শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগ নয়।’

করোনামুক্ত, তবে সুস্থ নন

প্রায় তিন মাস আগে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেছেন, তাঁর ক্লান্তি যাচ্ছে না। রাত ১১টা বাজতেই সারা শরীরে অবসাদ নেমে আসে। ঘুমানোর ইচ্ছা থাকলেও এখন আর গভীর ঘুম হচ্ছে না।

যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় করোনাজয়ী ১০০ ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। এসব রোগী আইসিইউ ও সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার চার সপ্তাহ পর তাঁদের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন গবেষকেরা।

ক্লান্তি বা অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ও মানসিক সমস্যার কথা করোনাজয়ীদের কাছ থেকে বেশি জানা গেছে। আইসিইউতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া করোনাজয়ীরা বেশি সমস্যার কথা বলেছেন। আইসিইউর ৭২ শতাংশ ও সাধারণ ওয়ার্ডের ৬০ শতাংশ ব্যক্তি বলেছেন, তাঁরা অবসাদগ্রস্ত। আইসিইউর ৬৬ শতাংশ ও সাধারণ ওয়ার্ডের ৪২ শতাংশ করোনাজয়ী বলেছেন, চার সপ্তাহ পরও তাঁদের শ্বাসকষ্ট যায়নি। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা গেছে আইসিইউর ৪৭ শতাংশ করোনাজয়ীর মধ্যে। আর সাধারণ ওয়ার্ডের করোনাজয়ীদের মধ্যে এই হার ২৪ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন করোনাজয়ী ১ হাজার ৫৬৭ জনের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর একটি জরিপ করে ২৫ জুলাই। কোভিড-১৯ ‘লং হলার’ সিম্পটমস সার্ভে রিপোর্ট শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনাজয়ীরা ৯৮ ধরনের সমস্যায় থাকার কথা বলেছেন। জরিপকারীরা সমস্যাগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। শারীরিক যন্ত্রণা দেয়, এমন সমস্যা ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আর যন্ত্রণাহীন সমস্যা ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে প্রায় সব করোনাজয়ী ক্লান্তি বা অবসাদে ভোগার কথা বলেছেন।

বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, ভাইরাসটি শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই শরীরে ঢোকে বটে, তবে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়ায়। শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা তন্ত্রে (সিস্টেম) ভাইরাস বাসা বাঁধতে পারে, তার কিছু প্রমাণ বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে পেয়েছেন। এই রোগ চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনায় আরও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে।