আশ্বাস ছাড়া কিছুই পায়নি ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া স্বাস্থ্যকর্মী তপনের পরিবার

তপন কুমার মণ্ডল
তপন কুমার মণ্ডল

রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচিতে এসে ডেঙ্গুতেই আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন মাদারীপুরের স্বাস্থ্য সহকারী তপন কুমার মণ্ডল (৩৫)। মৃত্যুর এক বছর হচ্ছে আগামীকাল শনিবার (১৫ আগস্ট)। এই সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই মেলেনি তপনের পরিবারের।

তপনের সহকর্মীরা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেমে ডেঙ্গুতে তপনের মৃত্যুর ঘটনা দেশে প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। তাঁর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছিল পরিবার। এরপর স্বাস্থ্য বিভাগ ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও কিছুই পায়নি তপনের পরিবার। জোটেনি একটি চাকরিও।

শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুর সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি গ্রামে তপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তপনের দুই শিশুসন্তান  চন্দন ও  গীতাঞ্জলি বাড়ির মেঝেতে থাকা বিছানায় বসে খেলা করছে। তপনের কথা ভেবে বাড়ির সবারই মন খারাপ। তাঁদের কারও মুখেই হাসি নেই। তপনের বৃদ্ধ মা–বাবা দুজনের চোখেই জল। মা ছেলের শোকে শয্যাশায়ী। ছেলের কথা মনে পড়লেই তাঁর মন কেঁদে ওঠে। তপনের মৃত্যুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

তপনের স্ত্রী মুক্তা অধিকারী (৩০)। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার আগেই বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের পর একান্ত মনোবল নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন। স্নাতক পাস করেছেন। সরকারি চাকরির বয়সও প্রায় শেষ। তবু স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে নিজেই এখন চাকরির পেছনে ছুটছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেও আশ্বাস ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো চাকরি মেলাতে পারেননি তিনি।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবারই যেন চোখে জল চলে আসছিল মুক্তা অধিকারীর। তিনি বলেন, ‘মানুষের সেবা করতে গিয়ে আমার স্বামীর প্রাণ গেল। কিন্তু তার প্রতিদানে আমরা কীই–বা পেলাম? স্বামীর মৃত্যুর এক বছর হয়ে গেল। অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে একটা খবরও কেউ নিল না। কীভাবে বেঁচে আছি, তা–ও কেউ জানে না। আমাকে চাকরি দেবে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে, এমন আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। দুই সন্তানকে ঘিরে ওদের বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। মেয়েকে ডাক্তার আর ছেলেকে ম্যাজিস্ট্রেট বানাবে। কিন্তু সব স্বপ্নই মনে হয় শেষ।’ তিনি আরও বলেন, খুব কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে। দু–একটা টিউশনি করে কি আর সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করা যায়? তবু সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তিনি জানেন না এভাবে কত দিন চলবে।

গত এক বছরে তপনের সহকর্মীরা তপনের স্ত্রীর একটি চাকরির জন্য বেশ কয়েকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে কোনো সুরাহা করতে পারেননি। এ সম্পর্কে তপনের সহকর্মী ও জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারী মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একই ব্যাচে চাকরিতে যোগ দেন। একসঙ্গেই ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। তপন মারা যাওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের (ডিজি) সঙ্গে তপনের স্ত্রীর চাকরির বিষয়ে দুবার দেখা করেন। তিনি দুবারই আশ্বাস দেন। তিনি একটি আবেদন দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর সদর উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে মহাপরিচালক বরাবর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) পদে আবেদন করেন মুক্তা অধিকারী। কিন্তু এখন পর্যন্ত আবেদনের কোনো উত্তর মেলেনি।

মজিবুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত তপনের পরিবার স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোনো টাকা পায়নি। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা পেয়েছিল। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে একটা চাকরির আশ্বাস দেওয়া হলেও কিছু পায়নি। স্বাস্থ্যের আগের ডিজি আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন তপনের স্ত্রীকে চাকরি দিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। এখন নতুন ডিজি এসেছেন, তিনি যদি এখন পরিবারটির প্রতি করুণা করেন।

তপনের প্রতিবেশী বলরাম মণ্ডল বলেন, ‘তপনেরা দুই ভাই ছিলেন। বড় ভাই ছোট্ট একটি ফার্মেসি চালান। পরিবারে ১১ জন সদস্যের দায়িত্বভার এখন তপনের বড় ভাই স্বপন মণ্ডলের ওপরে। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁর। পরিবারটির কথা ভাবলে আমাদেরও খারাপ লাগে।’