ফুলপুরে চার কারণে দুর্ঘটনায় পড়ে মাইক্রোবাসটি

উঁচু–নিচু সরু রাস্তায় অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই মাইক্রোবাসটি ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে।
ছবি: প্রথম আলো

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় আট স্বজন নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে মূল চারটি কারণের কথা বলছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংকীর্ণ সড়ক, অসমতল সড়ক, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ও ট্রাককে পাশ কাটানোর চেষ্টা। অসমতল সরু রাস্তায় ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে যায় মাইক্রোবাসটি।

চলতি বছরে হতাহতের দিক দিয়ে ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে গতকাল মঙ্গলবার। ফুলপুর উপজেলার বাঁশাটি গ্রামে ময়মনসিংহ-শেরপুর মহাসড়কে মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে একটি পুকুরে ছিটকে পড়লে ঘটনাস্থলেই এক শিশু ও চারজন নারীসহ আটজনের মৃত্যু হয়।

দুর্ঘটনার পর কারণ অনুসন্ধানে নামে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তারা ঘটনার প্রায় তিন ঘণ্টা পর দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিভিন্ন বিষয় মাপজোখ করেন এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত কারণ জানার চেষ্টা করেন। এ সময় বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সামাজিক সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

দুর্ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা যা বললেন

পরিদর্শন কার্যক্রম ও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআরটিএ ময়মনসিংহ কার্যালয়ের মোটরযান পরিদর্শক সাইফুল কবীর বলেন, এই সড়কটি সংকীর্ণ এবং এর প্রশস্ততা ১৮ ফুট। এ ছাড়া রাস্তাটি অসমতল। এক পাশে মাটি সমতলে থাকার পরিবর্তে প্রায় এক ফিট নিচে থাকার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ওই অসমতল ও সরু সড়কে একটি ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে মাইক্রোবাসটির চাকা মূল সড়ক থেকে নেমে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ হারানো গাড়িটি একটি ছোট্ট কাঁঠাল গাছে ধাক্কা দিয়ে পুকুরে পড়ে যায়।

সাইফুল কবীর বলেন, গাড়িটিতে ১০ জনের স্থলে ১৪ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে চলন্ত গাড়িটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল চালকের জন্য। কারণ এসময় ব্রেক সিস্টেম স্বাভাবিক নিয়মে কাজ করতে পারে না। তাই অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ।

দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্তের জন্য একজন যুগ্ম সচিব, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, হাইওয়ে পুলিশ এবং বিআরটিএর একজন পরিচালকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ফুলপুরের দুর্ঘটনা এলাকা পরিদর্শন শেষে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি আবদুল কাদের চৌধুরী বলেন, মূল পাকা সড়কটির পাশের মাটির স্তরটি এক ফুট নিচু। এ ছাড়া সড়কটি দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কার না হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে খানাখন্দ আছে। খানাখন্দগুলো অস্থায়ীভাবে মেরামত করা। আর মহাসড়কে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য রোড সাইন ও রোড মার্কিং জাতীয় কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এই সড়কগুলোতে হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে এবং মানুষের প্রাণহানি ঘটছে।

পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান বলেন, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই এবং সড়ক অবকাঠামোগত দুর্বলতাই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আয়শা হক জানান, অচিরেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে লাইসেন্স প্রদান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, মহাসড়কে সাইনবোর্ড, রোড সাইন ও মার্কার স্থাপনে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সাড়ে ৭ মাসে ৭৯টি দুর্ঘটনা

এই দুর্ঘটনাটি ছাড়াও চলতি মাসে মুক্তাগাছায় অপর আরেক সড়ক দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত হন।

বিআরটিএ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ১৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪৭ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ১৫৯ জন। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪৪ জন প্রাণ হারায়, আহত হয় ৮২ জন। চলতি ২০২০ সালে প্রায় পাঁচ মাস করোনাভাইরাসের প্রভাবে গণপরিবহন বন্ধ থাকা ও সীমিত পরিসরে চলার মধ্যেও দুর্ঘটনা থেমে নেই। এই সাড়ে সাত মাসে ৭৯টি দুর্ঘটনায় ১০৫ জন মারা গেছে এবং ৮৭ জন আহত হয়েছে।

মহাসড়কের সংস্কারকাজ এবং সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) ময়মনসিংহ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, ময়মনসিংহ-শেরপুর এই আঞ্চলিক মহাসড়কটিতে আগামী এক মাসের মধ্যে প্রশস্তকরণের কাজ শুরু হবে। কাজ শেষ হলে তখন এই সড়কটি ১৮ ফুট থেকে ৩৪ ফুট প্রশস্ততায় উন্নীত হবে। এই সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে নতুন করে রোড সাইন এবং রোড মার্কসহ আধুনিক পথনির্দেশনা ব্যবহার করা হবে। এই কাজগুলো শেষ হলে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।