অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের চক্রে দেশের ৬৫ লাখ দলিত

যশোরের ধলগ্রামের ঋষিপাড়ার বাসিন্দারা অল্প কিছুদিন আগেও স্থানীয় বাজারের রেস্তোরাঁয় বসে খেতে পারতেন না। কেননা, পেশায় মুচি এই পাড়ার বাসিন্দারা অন্যদের কাছে ‘ছোট জাত’, ‘অস্পৃশ্য’। জেলা প্রশাসনে অভিযোগ করা হলে গত জানুয়ারি মাসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেস্তোরাঁগুলোতে তাঁদের জন্য কিছু থালাবাসন ও চেয়ারটেবিল দিয়ে আসেন। তবে এটাও অবমাননাকর বলে মনে করেন ঋষিরা।
রেস্তোরাঁয় থালা ও আসবাব দিয়ে আসা বাঘারপাড়ার ইউএনও ইয়ারুল ইসলাম মনে করেন, এটি একটি বিকল্প ব্যবস্থা। গত সোমবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ঋষিরা রেস্তোরাঁয় খেলে মুসলমানেরা খেতে চায় না। ওদের ব্যবসায় সমস্যা হয়। আর বাড়ি কাছেই বলে এসব রেস্তোরাঁয় ঋষিদের খাওয়ারও খুব দরকার হয় না।’
দলিতদের বিরুদ্ধে অসংখ্য আর্থসামাজিক বৈষম্যের এটি একটি দিক মাত্র। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে তারা চরমভাবে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। দেশে দলিতদের সংখ্যা সরকারি হিসাবে প্রায় ৬৫ লাখ। ঝাড়ুদার, ডোম, সুইপার, চাশ্রমিক, বেদে সম্প্রদায়সহ সমাজের চোখে কিছুসংখ্যক ‘নিচু পেশার’ সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা দলিত হিসেবে পরিচিত।
এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যসুবিধার অভাব দলিতদের ব্যাপকভাবে পিছিয়ে রেখেছে। বেসরকারি সংগঠন নাগরিক উদ্যোগ ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে ‘বাংলাদেশে জাতপাতভিত্তিক অস্পৃশ্যতা, বঞ্চনা ও বৈষম্যচিত্র’ শিরোনামের এ গবেষণা চালায়। ১৮টি জেলার ১৭টি দলিত গোষ্ঠীর ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। মোট ৬৩২ জন জরিপে অংশ নেন।
জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় ছয় হাজার টাকার নিচে। সরকারের সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপ (২০১০) অনুসারে, জাতীয় পর্যায়ে খানা বা পরিবারের গড় আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা।
বৈষম্য রয়েছে শিক্ষার মতো সর্বজনীন ক্ষেত্রগুলোতেও। সৈয়দপুরের মুন্সীপাড়ার আশা রানী এখন নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তৃতীয় শ্রেণীতে একটি ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তি হতে গেলে তাকে নেওয়া হয়নি এ অজুহাতে যে তাতে ভদ্র ছেলেমেয়েরা আর আসবে না। এহেন আচরণে পিছিয়ে যায়নি আশার পরিবার। তবে গবেষণায় প্রায় ১২ ভাগ উত্তরদাতাই বলেছেন, অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য শুনে তাঁরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করেছেন।
দলিতদের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ৬৩ ভাগ। জাতীয় পর্যায়ে এ হার ২১ শতাংশ। এ রকম শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ৭৪ ভাগ বলেছেন, মূলত দারিদ্র্যের কারণে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। দলিত পরিবারের ৭২ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। জাতীয় পর্যায়ে এ হার এখন প্রায় ৯৮ শতাংশ।
দলিতদের এ অবস্থা জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান। তাঁর মতে, দলিতদের সামাজিক অগ্রগতির জন্য তাদের দৃশ্যমানতা বাড়াতে হবে। সামাজিক সংকটগুলো থেকে রক্ষা করতে তাদের সরকারের নিরাপত্তাজাল কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম-গোষ্ঠী-বর্ণভেদে কারও প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না বলে উল্লেখ আছে। এটিকেই এসব বৈষম্য রোধের একটি উপায় বলে মনে করেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, বৈষম্য রোধে সামাজিক সচেতনতার প্রয়োজন। তবে বৈষম্যবিরোধী একটি আইন তৈরিরও পরিকল্পনা হচ্ছে।
আজ বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস: ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২১ মার্চকে বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ‘বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এক হও, সমতা, দায়িত্বশীলতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করো’ এ স্লোগান সামনে রেখে এ দিবসের উৎপত্তি। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে কৃষ্ণাঙ্গদের মিছিলে বর্ণবাদী সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে ৬৯ জনকে হত্যা করে। এ কারণে বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে এ দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়।