আগের রাতেই ব্যালটে সিল

নিরাপত্তাব্যবস্থা, প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপ—সবই ছিল ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। তার পরও বিনা বাধায় কেন্দ্র দখল ও ব্যালট পেপারে গণসিল মারাসহ সব অপকর্মই হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে সরকারি দল-সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে এ কাজে যুক্ত হয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তাও।
উপজেলার ৪৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫-১৬টি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, ভোট শুরুর আগেই এসব কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা। সব কটিইে সকাল নয়টার মধ্যে ব্যালট পেপারের বাক্স অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেছে। কয়েকটি কেন্দ্রের দায়িত্ব নির্বাচনী কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, আগের রাতেই অর্ধেকের মতো ব্যালট পেপারে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মেজবাউল হায়দার চৌধুরীর প্রতীকে সিল মেরে রাখা হয়। পরে সকালে তা বাক্সে ঢোকানো হয়েছে। সকাল সাড়ে আটটায় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর নিজ গ্রামে পাঠাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর পক্ষে একদল যুবক বুথে ঢুকে ব্যালটে সিল মারছেন। সাংবাদিক দেখে ওই যুবকেরা বাইরে চলে যান। দেখা যায়, চেয়ারম্যানের বাক্সে অনেকগুলো ব্যালট ভর্তি আছে। অথচ ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের বাক্সে দু-একটি ব্যালট পড়ে আছে।
সকাল নয়টায় ছলেমা নজির উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা যায়, একাধিক বুথে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেজবাউলের কর্মী ও এজেন্টরা ব্যালটে গণহারে সিল মারছেন। সাড়ে নয়টার দিকে কন্ট্রাক্টর মসজিদ আশরাফিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ব্যালট পেপারে সিল মারার সময় কয়েকজনকে হাতেনাতে আটক করেন। এঁদের মধ্যে জামায়াত-সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর এজেন্ট আবদুল হাই নকল সিল ও প্যাডসহ আটক হন। পরে তাঁকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সোয়া ১১টায় দক্ষিণ বল্লভপুর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, ওই কেন্দ্রের সব কটি ব্যালট বই মেজবাউলের সমর্থকেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। আশপাশের বাড়িতে বসে সেসব ব্যালট পেপারে সিল মেরে এনে পরে বাক্সে ঢোকানো হচ্ছে। এ সময় একটি মহিলা বুথে ভোটদানের গোপন কক্ষে একজন যুবক ব্যালট পেপারের চার-পাঁচটি বই নিয়ে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীর ‘আনারস’ প্রতীকে সিল মারছিলেন। সাংবাদিক দেখে ব্যালটের বইগুলো ফেলে যুবক পালিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন কর্তব্যরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি কেন্দ্রের বেশির ভাগ ব্যালটই সিল মারা অবস্থায় দেখে সেগুলো বাতিলের জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে তাঁর মুঠোফোনে একটি কল আসে। ওই ফোনের পর ম্যাজিস্ট্রেট কেন্দ্র ছেড়ে চলে যান। অবশ্য দিনশেষে ওই কেন্দ্রের ৬০০ ব্যালট পেপার বাতিলের খবর পাওয়া গেছে।
দুপুর ১২টার দিকে ঘোপাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত এক কমকর্তা নিজেই আনারস প্রতীকে সিল মেরে একের পর এক ব্যালট বাক্সে ফেলছেন। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, ভোটের আগের রাতেই ফেনী সদরসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগের কর্মী ছাগলনাইয়ায় জড়ো করা হয়। তাঁরা সকালে ভোট শুরুর আগেই কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নেন।
অবশ্য কয়েকটি কেন্দ্রের কিছু ভোট বাতিল, একটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত ও উপজেলা সদরের কয়েকটি কেন্দ্রকে দখলমুক্ত রাখে প্রশাসন। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, তাঁর কাছে আগাম সিল মারা, কেন্দ্র দখল বা অন্য কোনো অনিয়মের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ করেনি।
আজ হরতাল ডেকেছে বিএনপি: ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে গতকাল দুপুরের আগেই সব কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশন ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেন বিএনপি-সমর্থিত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নুর আহম্মদ মজুমদার। দুপুরে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানান। তিনি জানান, বিএনপি আজ মঙ্গলবার ছাগলনাইয়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে।